উত্তরবঙ্গবাসীর একটাই দাবী তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন
- প্রকাশিত: ০৩:০৭:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫
- / 79
-হামীম আল ফুয়াদ
ভারতের সাথে ৫৪ টি আন্তর্জাতিক নদীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তা। এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোর জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার ও আন্তর্জাতিক নদী আইনের তোয়াক্কা না করা, এই অঞ্চলের কৃষি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জনজীবন।
তিস্তা নদী হিমালয় পর্বতমালা থেকে উদ্ভুত হয়ে ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত। উভর দেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য এই নদী জীবনদায়িনী সম্পদ। তবে শুষ্ক মৌসুমে পানি না দেওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও এ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম।
পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে ২০১২ সালে একটি খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত হয় দু দেশের মধ্যে। তবে এত বছর পরেও সে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া কিংবা বাস্তবায়ন কোনোটাই হয় নি, যা সত্যিই দু দেশের সুসম্পর্ক ও বাংলাদেশের কৃষির জন্য হতাশাজনক ও দু:খজনক। এমনকি ২০২২ সালে হওয়া দু দেশের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের বৈঠকেও চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে নূন্যতম আশাব্যঞ্জক কোনোকিছু দেখা যায় নি। বরং তিস্তা নদীর পানি চুক্তি কে অন্যান্য আন্ত:সীমান্ত নদীর সাথে জুড়ে দিয়ে বরং তিস্তাকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে ততকালীন দু দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের যৌথ বিবৃতি।
তিস্তার পানির এই অন্যায় অব্যবস্থাপনা উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য চরম ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসছে বহু বছর ধরে। একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। যেহেতু উত্তরের জেলা গুলো সেচ এর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না তাই রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা সহ আশেপাশের সমস্ত অঞ্চল তীব্র পানি সংকটে ভুগছে। পানি সংকটে এই অঞ্চলের ধান, ভুট্টা, পাট ও সবজি সহ অন্যান্য ফসলের ফলন কমে হ্রাস পাচ্ছে। এতে জাতীয় খাদ্য চাহিদা ও খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়াও ধান উৎপাদনে পানি বেশি প্রয়োজন হওয়ায় অন্যান্য কম সেচ প্রয়োজনীয় ফসলের দিকে মনোনিবেশ করছেন এ অঞ্চলের কৃষক। একসময় বছরে তিন মৌসুমে ধান উৎপাদন করলেও এখন তা কমে দুই কিংবা এক মৌসুমে আবাদ হচ্ছে। এতে করে এ অঞ্চলের কৃষি আয় কমে গিয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে বিশাল কৃষি জমি অনাবাদী থেকে যাচ্ছে যা গ্রামীণ বেকারত্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে।
এছাড়াও সেচ নির্ভর চাষাবাদ কৃষকের কৃষি উৎপাদন ব্যয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে যার ফলে ঋণগ্রস্থ হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষক এবং বাড়ছে অর্থনৈতিক পার্থক্য। ডিপ টিউবয়েল, শ্যালো মেশিন, ডিজেল ও বিদ্যুৎের খরচ বৃদ্ধি যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকের। একসময় চাষাবাদ বন্ধ করে শহরে পাড়ি যমাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষক। ভূগর্ভস্থ পানি নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে যা এ দেশের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি।
এছাড়াও উত্তরাঞ্চলের বাস্ততন্ত্র ও পরিবেশগত সমস্যা বেড়েই চলছে। বিপর্যয় হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবেশ ও আবহাওয়ার। এবং দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু সম্পর্কিত ক্ষয় ক্ষতির৷ পানি শুন্যতায় শুকিয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা সংযুক্ত শত শত খাল, উপনদী ও নদী সহ অন্যান্য জলাধার। এতে করে চরাঞ্চল বেড়ে যাচ্ছে এবং জলজ উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের পরিবেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে বসবাসের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে নদী ভাঙণের ফলে বাড়িঘর হারাচ্ছেন চরাঞ্চলের মানুষ। দেশের অর্থনীতির উপর যা চাপ ফেলছে নিয়মিত।
উল্লেখিত সকল সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক, কৃষকের জীবন-জীবিকা। বেকারত্ব বাড়ছে, খাদ্য চাহিদা অপূর্ণ থাকছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর।
এমতবস্থায় তিস্তা পাড়ের মানুষেকে দীর্ঘ দিনের পানি সন্ত্রাসের শিকার হওয়া থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসে চীন। দেশটি ২০২২ সালে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত ব্যয় (৮.৫ হাজার কোটি টাকা);চীনের একটি ব্যাংক তার সমুদয় অর্থ ঋণ হিসেবে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক সম্মতি দেয় । এ চুক্তি অনুযায়ী, তিস্তা নদীর ডান ও বাম উভউ তীর ঘেঁষে গড়ে উঠবে ২২০ কিলোমিটার উঁচু গাইড বাঁধ, বিভার ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল রেস্তোরাঁ, পর্যটন কেন্দ্র, ১৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প কারখানা, ইপিজেড, ইকোনমিক জোন, বনায়ন ও কয়েক লাখ হেক্টর জমি উদ্ধার ইত্যাদি। কর্মসংস্থান পাবে তিস্তা পাড়ের ২০ লাখ মানুষ। মানুষের জীবনমানে আসবে অভাবনীয় পরিবর্তন। নদীতে ১০ মিটার গভীরতা বৃদ্ধি করে এ অঞ্চলের আবাদি জমিতে পানির চাহিদার পুরোটাই পূরণ করবে তিস্তা। বাংলাদেশ অংশে আর প্রয়োজন পড়বে না ভারতের অতিরিক্ত পানির। এবং বন্যা রোধে এ মহাপরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নদী ভাঙ্গণ থেকে রক্ষা পাবে ৫০ হাজার মানুষ। এবং নৌ-যান এর জন্য পর্যাপ্ত পানির যোগান থাকবে তিস্তায়।
উল্লেখ্য ২০২২ সালে চীনের রাষ্ট্রদূত নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট এ এসে তিস্তা নদীর অববাহিকা ও দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শন করে পূর্ব চীনের সুকিয়ান সিটির আদলে স্যাটেলাইট সিটি গড়ার আশ্বাস দেন। তবে ততকালীন স্বৈরাচার আমলে অতি ভারত প্রীতি কিংবা ভারতের চীন ভীতির কারণে তা আর আলোর মুখ দেখে নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উত্তরের জেলা গুলো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।
দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে উত্তরবঙ্গের প্রত্যাশা অনেক। চলতি সপ্তাহে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জনাব ড. ইউনুস চীন সফরে যাচ্ছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা সহ নানান ইস্যুতে দু দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে৷ এমতবস্থায় উত্তরের মানুষের পক্ষ থেকে একটা দাবী – দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করে মঙ্গা থেকে মুক্তি।