এখনো টিকে আছে ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী নেকমরদ ওরস মেলা
- প্রকাশিত: ০৫:০০:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 67
মোঃ মাহিম মুনতাসির
ঠাকুরগাঁও জেলাধীন রানীশংকৈল থানার ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ হলো নেকমরদ। উল্লেখিত স্থানে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মেলাটি পীর শাহ্ নেকমরদ (রাঃ) এর মর্যাদা রক্ষায় তার ওরসে নেকমরদ ওরস মেলা নামে অভিহিত হয় । বৃটিশ আমলেও মেলাটি অব্যাহত ছিল এবং সমৃদ্ধিও ছিল প্রচুর ।১৮৬০ সালে প্রণীত মেজর শের ইউলের ভুমি নকশায় মেলাটির চিহ্ন পাওয়া যায়।
ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে এবং ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে দিনাজপুরের অন্তর্গত প্রাচীন পরবর্তন রাজ্যে যে আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধ মেলার পরিচয় পাওয়া যায় তা যে নেকমরদের এই ঐতিহ্যবাহী ওরস মেলা এ বিষয়ে কোনো মতানৈক্য নেই। এছাড়াও ফার্সি ঐতিহাসিক গ্রন্থ তাবকা-ই-নাসিরীর বরাত দিয়ে ডক্টর রায়ের গ্রন্থের মেলার উল্লেখ্য পাওয়া যায়।নথিপত্রে পাওয়া যায় মেলাটি ১লা বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে এক মাস স্থায়ী থাকতো পরে তারিখ পরিবর্তন করে ১৯৬১ সন থেকে কার্তিক মাসের রাস পূর্ণিমার দিন ধার্য করে একমাস স্থায়ী থাকতো। বর্তমানে মেলাটি আমন ধান কাটার পর ১লা ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে।
তৎকালীন দিনাজপুর জেলা মেলার জেলা হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল । দিনাজপুরের মেলাগুলোর মধ্যে নেকমরদের ওরস মেলা বাণিজ্য ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে তীর্থমেলার পবিত্রতায় বেশি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। টাঙন ও তঙ্গন ঘোড়ার বেচাকেনার জন্য মেলাটি আন্তর্জাতিক ভাবে প্রসিদ্ধ ছিল। পার্শ্ববর্তী জেলা সমূহ থেকে এই মেলায় গরু, মহিষ ভেড়া আসত। ময়মনসিংহ, সিলেট ও যমুনা নদীর পারের অঞ্চল থেকে আগত ব্যাপারিরা সে সব পশু কিনে নিয়ে যেত । ভুটান ও পশ্চিম ভারত থেকে আসত ভূটুয়া ঘোড়া , পশ্চিমা ঘোড়া ,মহিষ ও উট ।আসাম, দার্জিলিং ও তরাই অঞ্চল থেকে আসত হাতি। এই হাতি ক্রয় করতো স্থানীয় ও পাশের জেলার মহাজনরা । উত্তর -পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর থেকে মোঘল পাঠানবংশীয় সওদাগরেরা শুকনা ফল ও কারুকার্য খচিত ঘোড়ার জ্বীন,ধারালো ছোরা, তীক্ষ্ণধার, তরবারী, স্ফটিক আয়না ইত্যাদি বহু বিলাস দ্রব্য উটের পিঠে করে নিয়ে আসত।শিখেরা আনত হাতির দাঁত,চন্দন কাঠের চিরুনি ,গলার মালা ইত্যাদি ।পাহাড়িগণ আনত কজ্জল,মৃগনাভী,গরম বস্ত্র,বাদাম ও পনীর।
নেপালীরা আনত কুক্কুরি ও চিরতাপাতা ।দিনাজপুরের ব্যবসায়ীরা বিক্রয় করত কৃত্রিম মুক্তার মালা ,কার্পাস,চট,রেশমী কাপর ও পাট বস্ত্র। অতীত কালে মেলাটি বহুদূর বিস্তৃত ছিল।প্রায় ১০ বর্গমাইল জুড়ে মেলাটি বসত । পীরের মর্যাদা ও মহিমার কারনেই মেলাটি সর্বব্যাপি প্রসিদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
নেকমরদ মেলার আর সেই সাবেক জৌলুস নেই। নেকমরদ মেলার পুরোনো জৌলুস এখন রূপকথার কাহিনী মাত্র। বৃটিশ সরকারের কুখ্যাত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন , মুসলিম জমিদারদের দেউলিয়া হওয়া , প্রভাবশালী হিন্দু জমিদারদের দখলদারি, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, দিনাজপুরে প্লেগ রোগ ছড়ানোসহ নানান চক্রান্তের কারনে এই মেলা আর আগের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হয় না ।
এ বিষয়ে মোঃ আহাদ ( ঢাবি;১৫-১৬ সেশন) শিক্ষার্থী বলেন আমি যখন ছোট ছিলাম মেলাটা অনেক জাঁকজমকপূর্ণ ছিল । আমি ছোট থেকেই মেলার নামে অনেক গল্প কাহিনী শুনছি । অনেক বাঁধার পরও এই ঐতিহ্যবাহী মেলাটা টিকে আছে এখনো একমাস ব্যাপি মেলাটি চলে । আমাদের শীতকালীন ছুটির মূল উদ্দেশ্য থাকে মেলা দেখার ।আমি চাই আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী মেলাটিকে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও বাংলাদেশ জাতীয় সংস্কৃতি পরিষদ (বাংলা একাডেমি) কর্তৃক ঐতিহ্যবাহী মেলার স্বীকৃতি যেন দেওয়া হয় ।
মেলা কমিটির সাবেক সেক্রেটারি ও বর্তমান কমিটির সদস্য হারুন অর রশীদ (শাহিন) বলেন এই মেলা হাজার বছরের পুরোনো।আমি যখন ছোট ছিলাম মেলাটি অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ছিল।সারা দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো ব্যবসা করতো তারা তাবু টাঙিয়ে রাত থাকতো ।বিশেষ করে গরু, মহিষ,ঘোরার অনেক বড় হাট লাগতো । মেলাতে অনেক বিনোদন এর ব্যবস্থা থাকতো সারাদেশে মানুষ এই মেলা দেখতে আসতো । কিন্তু বর্তমানে জায়গায় সংকটের কারনে মেলাটি আগের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হয় না। আগের মতো নাম-ডাক না থাকলেও বর্তমানে মেলাটি অনেক জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই লাগে। প্রাই ৩০ একর জমির উপর মেলাটি বিস্তৃত আছে । ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে মেলাতে।
বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ের নেকমরদ ওরস মেলা ডিসেম্বর এক তারিখে শুরু হয়ে পুরো মাস চলে ৩১ ডিসেম্বরে শেষ হয়। মেলার আগের মতো জৌলুস না থাকলেও তার ঐতিহ্য অনেকখানি ধারন করে আছে ।মেলাতে সারা দেশ থেকে দোকান পাঠ আসে ।গরু,মহিষ,ঘোরা ,ভেরাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায় । বিনোদনের জন্য দেশের বিখ্যাত বড় সার্কাস,জাদুখেলা,কার ও মটরসাইকেল খেলা,গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালা মেলায় অবস্থান করে । শিশুদের জন্য দোলনা,চিরিয়াখানাসহ গ্রাম বাংলার অনেক ঐতিহ্যবাহী খেলা অনুষ্ঠিত হয়।মেলায় গ্রাম বাংলার কারুকার্য খচিত অনেক আসবাবপত্র ও রকমারী স্থানীয়জাত দ্রব্য পাওয়া যায় । ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষ ছাড়াও আশেপাশের অনেক জেলার
মানুষ আসে মেলা দেখতে ।