চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি নিয়ে যা ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা
- প্রকাশিত: ১১:১১:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
- / 41
দীর্ঘদিন যাবত চাকরিপ্রার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবি জানিয়ে আসছেন, তাদের এই দাবির মুখে বর্তমানের অর্ন্তবর্তী সরকার এ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করে দেন, গত ১২ অক্টোবর সেই কমিটি ছেলেদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ এবং মেয়েদের ৩৭ বছর করার জন্য সুপারিশ করেছেন। তাদের এই সুপারিশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদেরকে এই সুপারিশকে নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করতে দেখা গেছে ৷ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে কি ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থীরা, তাদের সেই ভাবনা বা কথাগুলো তুলে ধরেছেন পাবলিকিয়ান টুডে’র হাবিপ্রবি প্রতিনিধি মোঃ রাফিউল হুদা:-
চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ মুহিত হোসাইন সরকার বলেন, বিভিন্ন দেশে চাকরির কোনো বয়স সীমা না থাকলেও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৩২ থাকা উচিত। কারণ, দেশের যে পরিস্থিতি তাতে বয়স বাড়ালে দেখা যাবে যে শুধু সরকারী চাকরির পিছনেই ছূটবে দেশের একটা সংখ্যা গরিষ্ঠ তরুণ সমাজ। এতে যেমন একদিকে সরকারী চাকরিতে প্রচুর প্রতিযোগিতা হবে , অন্য দিকে অধিকাংশ তরুণ সমাজ শুধু চাকরির পিছনে নিজেদের একটা বড় সময় নষ্ট করবে। সেটা সে অন্য কাজে ব্যয় করলে নিজের এবং দেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারত । আর সরকারী চাকরিতে নিয়োগ অত্যন্ত সীমিত। এই দেশের সিস্টেমে শুধু গুটিকয়েক চাকরি পাবে আর বাকিরা চাকরির জন্য বছরের পর বছর লেগে থাকবে। এটা মেধা ও শ্রমের অপচয় এবং দেশের একপ্রকার বড় ক্ষতি বলে আমি মনে করি। তাই সব দিক বিবেচনায় চাকরিতে বয়স ৩২ থাকা উচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী বিকাশ চন্দ্র শীল বলেন, এদেশের প্রতি টা তরুণ / তরুণীর স্বপ্ন থাকে একটা সরকারী চাকরির। যার মাধ্যমে সে দেশ বা জাতির একজন অংশীদার হয়ে কাজ করবে।কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন আর সরকারী চাকরির আনুপাতিক হার হিসেবে ৩৫ বছর কখনোই দেশের জন্য মঙ্গলকর কিছু বয়ে আনবে না। কারণ, এমনিতে আমাদের দেশের বেকারের সংখ্যা অনেক তাতে যদি আবার ৩৫ করা হয় তাহলে ভাবেন বেকারত্বের সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে । উন্নত দেশের সাথে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট এক না, আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে আমাদের দেশের সরকারী চাকরির একটা সম্পর্ক আছে । ৩৫ করা হলে বেকারত্বের সাথে আমাদের মানসিক অবস্থারও অবনতি ঘটবে বলে আমি মনে করি । তাই মনে করি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ না করে ৩২/৩৩ করা উচিত হবে আমাদের দেশের অবস্থা ভেবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের শিক্ষার্থী রিদওয়ান রাফি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির পক্ষে নই। কারণ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলেও পদের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।বাংলাদেশে সরকারি চাকরি ‘সোনার হরিণের’ মতো। সুযোগ পেলে সকলেই ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত চেষ্টা করবে। ফলে চাকরি প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যাবে। চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতাও অনেক বেড়ে যাবে। বয়সসীমা বৃদ্ধি পেলেই যে সকলে সরকারি চাকরি পাবে , বেকারত্ব কমে আসবে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। যাদের সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়েছে অথবা বয়স শেষের পথে সাময়িকভাবে তারাই হয়তো উপকৃত হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করা একজন শিক্ষার্থী ও যার চাকরির বয়সসীমা শেষের পথে, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অবশ্যই সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করা শিক্ষার্থী পিছিয়ে থাকবে। কারণ চাকরির প্রতিযোগিতায় অভিজ্ঞতারও অনেক মূল্য আছে। অন্যদিকে অবসরের সময়সীমা যদি ৬৫ বছর করা হয়, তাহলে চাকরির পদগুলো খালি হতে অনেক সময় লাগবে। নতুনরা চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগবে। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিবে।একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে এক বছরে আত্মহত্যা করেছেন ৫১৩ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে একটা বৃহত্তর অংশ চাকরি প্রত্যাশী।
অন্যদিকে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ রয়েছে ১৯ লাখ ১৫১ টি। এর মধ্যে শূন্য পদ রয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭ টি। চাকরি বিজ্ঞপ্তি না থাকায় এই সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন এই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা।
আমার মতে, চাকরির বয়সসীমা না বৃদ্ধি করে দ্রুতগতিতে পিএসসি সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে উপযুক্ত পদ্ধতিতে মেধাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শূন্য আসনগুলো পুরণ করা গেলে এই সংকট থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ রবিউল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধি করা হলে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে, উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে যা কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াবে। এছাড়া নেতিবাচক প্রভাব ও পড়তে পারে, বেকারত্বের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে, দেশে এখনো অনেক শিক্ষিত তরুণ রয়েছে, যারা চাকরির জন্য অপেক্ষা করছে। নতুনদের জন্য প্রতিযোগিতার হার বেড়ে যাবে কারণ একইসঙ্গে মধ্যবয়সী ও তরুণরা আবেদন করবে। এতে তরুণদের ক্ষেত্রে এক রকম হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। দেরিতে চাকরিতে প্রবেশের কারণে তাদের কাজের সময়সীমা কমে আসবে এক্ষেত্রে অবসরকালীন সুবিধা ও পেনশন প্রদানের ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি হবে যা অর্থনীতির উপর একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বয়সসীমা বৃদ্ধির ফলে নতুন প্রজন্মের চাকরির প্রতিযোগিতে বৃদ্ধি, সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় বৃদ্ধি,কাজের সময় কমে আসা, পেনশন সুবিধার চাপ ইত্যাদি অর্থনীতিতে একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত এ পরিবর্তন বাস্তবায়নের আগে অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা উচিত যাতে ভারসাম্যপূর্ণ প্রভাব নিশ্চিত করা যায় এবং একটি সূষম নীতি গ্রহণ করা, যাতে দক্ষতার সঠিক ব্যবহার হয় এবং নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ ও অক্ষুন্ন থাকে।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম নিশাত বলেন, আমি মনে করি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি যৌক্তিক । কিন্তু সর্বোচ্চ ৩২ করা হলে সবার জন্য ভালো হবে। উচ্চশিক্ষার দীর্ঘ সময় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত সময় পাওয়া সুবিধাজনক। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পড়াশোনায় যে ব্যাঘাত ঘটেছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বয়সসীমা বৃদ্ধি জরুরি বলে অনেকে মনে করেন।
তবে, বয়সসীমা বৃদ্ধি করলে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে, কারণ অধিক বয়সী প্রার্থীদের সঙ্গে তুলনায় নতুন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য সুযোগ কমে যেতে পারে। সামগ্রিকভাবে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে নীতিগতভাবে বয়সসীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও দ্রুততর হওয়া উচিত।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ বিল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ বছরে বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
আমার কাছে মনে হয় বয়সসীমা বাড়ানোর ফলে চাকরিতে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। বেশি সংখ্যক প্রার্থী একই পদে আবেদন করবে। এদিকে চাকরি পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করবেন। ফলে রাষ্ট্রে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে। এছাড়া নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ কমে যাবে। চাকরিতে একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। তাই সরকারী চাকরিতে বয়সসীমা ৩০ রাখা উচিত।
তবে, চাকরিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করা যায়। শুধুমাত্র বয়সের উপর নির্ভর করে নয়, বরং যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন করা যেতে পারে। বিভিন্ন পদের জন্য বিভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণা বা বিশেষজ্ঞ পদের জন্য বয়সসীমা কিছুটা বেশি রাখা যেতে পারে।
মো. রাফিউল হুদা,হাবিপ্রবি