প্রতিষ্ঠার ২৫ বছরেই গবেষণায় চমক দেখাচ্ছে হাবিপ্রবি
- প্রকাশিত: ০২:১০:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ জুন ২০২৪
- / 53
হাবিপ্রবি প্রতিনিধি: বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা । যে তথ্য ও প্রযুক্তিগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সমন্বয় সাধন করে জীবনকে সহজ করে। সেই ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের দেশের ৫৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালিয়ে আসছে ৷ যে গবেষণা কার্যক্রমগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের জন্য বয়ে আনছে সুনাম। এছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্মিলিত প্রয়াসে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা খাত। এরই মধ্যে প্রাণী, শস্য, মেশিন সব ধরনের গবেষণায় চমক দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষকরা। হাবিপ্রবির এমন চমক দেখানো অন্যতম কিছু গবেষণা তুলে ধরেছেন পাবলিকিয়ান টুডে’র হাবিপ্রবি প্রতিনিধি মো. রাফিউল হুদা
উচ্চ ফলনশীল ও অধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ টমেটোর জাত উদ্ভাবন
উচ্চ ফলনশীল ও অধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ চেরী টমেটোর নতুন দুটি জাত উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন হাবিপ্রবি শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আরিফুজ্জামান ও তার গবেষকদল । বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে উদ্ভাবিত এই চেরী টমেটোর জাতের প্রতিটি গাছে পাঁচশটিরও অধিক ফল এবং হেক্টর প্রতি ১৮০ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। সাধারণ টমেটো গাছ যেখানে ৩ থেকে ৪ মাস বেঁচে থাকে সেখানে এই জাতের গাছগুলো সঠিক পরিচর্যায় ৫ থেকে ৬ মাস বেঁচে থাকে এবং ফল দেয়। এছাড়া অন্যান্য চেরী টমেটোর থেকে এই চেরী টমেটোর ১ গ্রামে থাকে ৭২ মাইক্রোগ্রাম লাইকোপেন এন্টি অক্সিডেন্ট । আর এই এন্টি অক্সিডেন্ট হার্টের সমস্যা ও স্থুলতা কমাতে অন্যান্য টমেটোর থেকে বেশি সহায়তা করে।
অধ্যাপক ড. আরিফুজ্জামান ছাড়াও হাবিপ্রবির আরেক গবেষক ড. আজিজুল হক ও তার দলও টমেটোর নতুন জাত উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন। যার নাম ‘বিপুল প্লাস’। কোনোরকম বিষ ও হরমোন প্রয়োগ ছাড়াই খুবই স্বল্পমাত্রায় ইউরিয়া (টিএসপি, পটাশ) ও ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে এই টমেটো উৎপাদন করা হয়েছে। ‘বিপুল প্লাস’ চাষে খুবই সহজলভ্য কিছু নাইট্রোজেন স্থায়ীকরণ ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্যই এমন অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে বলে জানান গবেষণা দলটি।
ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের ফলে ‘বিপুল প্লাস’ সাধারণ টমেটো গাছের তুলনায় আকার আয়তনে অনেক বড় এবং অধিক সবুজ। সেই সঙ্গে গবেষণালব্ধ এই গাছে টমেটোর ফলন প্রায় চারগুণ বেশি। একেকটি গাছে প্রায় ২৬০টির মতো টমেটো পাওয়া যাবে। টমেটোগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনও লক্ষ করা গেছে। এতে পানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম, ফলের সলিড অংশই বেশি এবং খেতেও সুস্বাদু। গবেষকরা আশা করছেন, এই টমেটো ফ্রিজে না রেখেই এক মাস সময় পর্যন্ত ভালো থাকে।
একই খরচে অল্প সময়েই শুকাবে শস্য :
হাবিপ্রবির শিক্ষক ড. মো. সাজ্জাত হোসেন সরকারের নেতৃত্বে উদ্ভাবিত হয়েছে শস্য শুকানোর মেশিন (টু স্টেজ গ্রেইন ড্রায়ার)। এ মেশিনের মাধ্যমে বৈরী আবহাওয়াতেও স্বল্প সময়ে সীমিত খরচে ধান, গম, ভুট্টা শুকানো যাচ্ছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে শস্য সংগ্রহে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করা হয় মেশিনটিকে। চাতালে শুকানোর খরচেই মাত্র কয়েক ঘণ্টায় শুকাতে পারছেন ব্যবসায়ীরা।
এরই মধ্যে এর সুফল পেতে শুরু করেছেন স্থানীয় কৃষকেরা। দেশের প্রতিটি উপজেলায় সরকারিভাবে শস্য শুকাতে এ ধরনের মেশিন স্থাপন করা হলে কৃষকেরা যেমন উপকৃত হবেন অন্যদিকে ফসল নষ্টের সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে আসবে। এ মেশিন সরকারের ধান, চাল সংগ্রহে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মত প্রকাশ করেন উদ্ভাবনের নেতৃত্বে থাকা গবেষকরা।
তাপ সহিষ্ণু গমের জাত উদ্ভাবন
বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের কৌলিতত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. হাসানুজ্জামান তাপ সহিষ্ণু গমের এই জাত উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন । নতুন জাতের এই গমগাছগুলো অধিক তাপসহিষ্ণু এবং উচ্চ তাপমাত্রায় উচ্চ ফলন ধরে রাখতে সক্ষম। কেননা, এর কাণ্ডে ও ত্বকে পরিণত আবরণের পরিমাণ বেশি থাকে। তিনটি অনুমোদিত জাত ও একটি অগ্রবর্তী সারির বারি-৪ গমের ক্রস প্রজননের মাধ্যমে তিনটি নতুন ধরনের তাপ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছেন গবেষকরা। যাদের নামকরণ করা হয়েছে এইচএসটিইউ ডাব্লিউ-১, এইচএসটিইউ ডাব্লিউ-৪ ও এইচএসটিইউ ডাব্লিউ-৮।
এছাড়াও নতুন উদ্ভাবিত এই তাপ সহিষ্ণু গম রোপণের প্রায় ১০০ দিনের মধ্যেই ফলন দিতে সক্ষম। এমনকি এই জাতে শিষের সংখ্যা যেমন বেশি,তেমনি প্রতি শিষে পুষ্ট দানার সংখ্যাও বেশি হয়।
ধানে উৎপাদন বেড়েছে ৫০-৫৫ শতাংশ :
বেগুন, টমেটোর পর রাসায়নিক কীটনাশকমুক্ত ধান উৎপাদনে বাম্পার ফলন পেয়েছেন ড. আজিজুল হক ও তার গবেষক দল। ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৯২, ব্রি-৩৪, জিরাশাইলসহ মোট ৬টি জাতের ধানের উপর গবেষণা চালিয়ে এই সফলতা এসেছে। গবেষকরা কৃষকের সাথে ফিল্ড ট্রায়ালের মাধ্যমে ৫০% ইউরিয়া প্রয়োগ কমিয়ে, মাত্র ১ বার (ধান রোপণের প্রথম মাসে) বিষ প্রয়োগ করে ধানের উৎপাদন ৫০-৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছেন।
জানা যায়, অত্যন্ত প্রচলিত ব্রি-২৮ (বোরো) এবং ব্রি-৩৪ (আমন) জাতের ধানগুলি ব্লাস্টসহ অন্যান্য রোগের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। ফলে ধানে অতিমাত্রায় প্রায় ৪-৬ বার কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। এতে ধানের উৎপাদন প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কমে যায় ও চালের নিউট্রিয়েন্ট ফোর্টিইফিকেশন ব্যাহত হয়। কিন্তু নতুন এই ধান গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিতকারী এনডোফাইটিক ব্যাকটেরিয়া গাছের শিকড়, কাণ্ড, শাখা ও প্রশাখা বৃদ্ধির মাধ্যমে নাইট্রোজেনের বাড়তি জোগান বায়ুমণ্ডল থেকে সংগ্রহ করে। ফলে ইউরিয়া সারের প্রয়োগ ৫০-৭০ শতাংশ কমে যায়। এই গবেষণায় কিছু এনডোফাইটিক ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণ অক্সিন হরমোন, এসিসি ডি-আমেনেজ এনজাইম তৈরি করে। এছাড়াও তারা বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন নিক্ষেপ করে থাকে। উক্ত ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগে ব্রি-২৮ ধানের উৎপাদন গড়ে প্রায় ৫০-৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে ধানের খড়ে সেলুলোজ বৃদ্ধি পাওয়াতে খড়ের হার্ডনেস ২.০ গুন বৃদ্ধি পায় এবং খড় অনেক সবল ও সুস্থ থাকে।
উটপাখিতে খরচ কমবে ৩০-৩৫ হাজার টাকা
দেশে প্রথমবারের মতো ইনকিউবেটরে উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে দেশের গবেষণায় এক নজির স্থাপন করেছে হাবিপ্রবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের গবেষণাগারে এটি পরিচালিত হয়। ইনকিউবেটরে ১৯টি উট পাখির ডিম দেড়মাস রাখার পর চলতি বছরের ১১ জুলাই একটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে। যার ওজন ছিল ৯৪৮ গ্রাম।
জানা যায়, প্রায় আড়াই বছর ধরে উটপাখির বংশবৃদ্ধি, বাণিজ্যিকভাবে উটপাখি চাষ করে দেশে প্রোটিনের জোগান দেওয়ায় বিষয়ে গবেষণা করছিলেন হাবিপ্রবির জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগ। তিন দফায় প্রায় অর্ধ শতাধিক ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর চেষ্টার পরে সফলতা আসে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে উটপাখির বংশ বিস্তারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। একটি উটপাখির বাচ্চা আমদানিতে খরচ হয় প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা। সেখানে দেশে গবেষণা অব্যাহত থাকলে এই খরচ ১০-১৫ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
বেগুনের উৎপাদন বাড়বে তিন-চার গুণ
বিষমুক্ত বেগুন উৎপাদনের লক্ষ্যে বায়োফার্টিলাইজার (এন্ডোফাইটিক ব্যাকটেরিয়া) প্রয়োগে সফলতা পেয়েছেন হাবিপ্রবির বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আজিজুল হক হেলাল ও তার একদল গবেষক শিক্ষার্থী। সফল এই গবেষণার ফলে তিন থেকে চারগুণ বেশি এবং প্রায় শতভাগ বিষমুক্ত বেগুনের ব্যাপক ফলন ঘটেছে। একজন কৃষক জমিতে প্রতি শতকে যতটুকু ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন তার ৭০ শতাংশ ব্যবহার কমানো এই গবেষণার মাধ্যমে। বেগুন ছিদ্র করতে আসা পোকাকেও বাঁধা দেয় এই বায়ো ফার্টিলাইজার। বায়োফার্টিলাইজার (ব্যাকটেরিয়া) প্রয়োগের ফলে জমিতে কীটনাশকের ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় এনেছেন গবেষক দলটি। পাশাপাশি বেগুনের ফলন এবং আকারের পরিবর্তন লক্ষণীয় মাত্রায় পৌঁছেছে।