বুটেক্সে ছাত্ররাজনীতি বন্ধে নিরাপত্তা নিয়ে ভয় নাকি অন্য কিছু!
- প্রকাশিত: ০৬:৫৭:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪
- / 43
—মাহবুব আলম রিয়াজ
১৭ জুলাই রোজ বুধবার। একটি পোস্টার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে বুঝার বাকি থাকে না যে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) নতুন কিছু হতে চলছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আর ছাত্ররাজনীতি চান না। উক্ত দিনে বুটেক্স ক্যাম্পাসে যেকোনো ধরনের ছাত্ররাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালক বরাবর পিটিশন জমার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে আসতে বলা হয়।
দুপুর ৩টায় ক্যাম্পাসের পকেট গেইটে (দ্বিতীয় গেইট) প্রবেশকালে গেইটে লাগানো কয়েকটি কাগজে সবার নজরে পড়ে। সেখানে লেখা ‘ছাত্রলীগ প্রবেশ নিষেধ’। ক্যাম্পাসের ভেতর প্রবেশ করে দেখা গেলো শত-শত শিক্ষার্থী অবস্থান করেছে। তাদের একটাই দাবি; ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীরা ‘No Student Politics’, ‘দালালমুক্ত বুটেক্স ক্যাম্পাস’ ইত্যাদি লিখে। পাশাপাশি ছাত্রসংসদের ভেতরে ছাত্রলীগের লোগো ও অনার বোর্ডের লেখা মুছে ফেলেন শিক্ষার্থীরা।
হঠাৎ কী এমন হলো যে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার আন্দোলন! কেনই বা শিক্ষার্থীরা এমন শুরু করলেন!
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আন্দোলনের সূত্রপাত যেখানে
কয়েক সপ্তাহ যাবত দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রধান শিরোনাম কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে। আন্দোলনকে ঘিরে নানা ধরনের সংঘাত, সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শত-শত শিক্ষার্থীর তাজা প্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সোমবার (১৫ জুলাই) বুটেক্স ছাত্রলীগ নেতার একটি গ্রুপ ছবি ফেসবুকে পোস্টের পর শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে বুটেক্স নেতাকর্মীদের সেই গ্রুপ ছবির সমালোচনায় ছবিটি ফেসবুক থেকে সরিয়ে নেন সেই নেতা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সেদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে। আর বুটেক্স ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান। যদিও বুটেক্স ছাত্রলীগ নেতারা হামলার সাথে যুক্ত ছিলেন না জানান। বুটেক্স ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ ফেসবুকে পোস্ট কিংবা স্টোরিতে যেসব লেখা বা ছবি প্রচার করেন তা ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় সমর্থন বুঝায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় যারা অভিযুক্ত তাদের বয়কটের ডাক দেন শিক্ষার্থীরা। ১৫ জুলাই (সোমবার) মধ্যরাত থেকে ফেসবুকে শিক্ষার্থীরা জানান, ‘কোনো শিক্ষার্থী যদি আজকে বা আগামীতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী তথা আমাদের ভাই-বোনদের ওপর আক্রমণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা অথবা হামলাকারীদের সহযোগিতা বা তাদের ডিফেন্ড করার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাকে আমাদের ব্যাচ থেকে বর্জন করবো এবং আমাদের সাথে কোনো প্রকার ক্লাস বা কোনো ধরনের পরীক্ষায় সে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।’
ঘোষণার পর থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রচারিত গ্রুপ ছবিতে যেসব শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে তাদেরকে ব্যাচ ও বিভাগ থেকে বয়কট করা হয়। ছবি, নাম ও অন্যান্য পরিচয়সহ ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে বয়কটের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে বয়কট হওয়া কিছু শিক্ষার্থী ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন এবং বলেন সামনে আর রাজনৈতিক কার্যক্রমে তারা যুক্ত থাকবেন না।
পরদিন মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) তেজগাঁওয়ের তিব্বত-নাবিস্কোতে দুপুর ১২টার দিকে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের ডাক দেয় বুটেক্স, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। উক্ত দিনে সকালে বুটেক্স ছাত্রলীগের প্রায় ২০ জন নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে জড়ো হন এবং একসাথে গ্রুপ ছবি তুলে ফেসবুক প্রচার করেন। সাড়ে ১১টার দিকে এক সাংবাদিকের সাথে ঘটে বিপত্তি। বুটেক্স ছাত্রলীগের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে অনেক নেতাকর্মী একসাথে হয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত ক্যাম্পাসের সাংবাদিক সমিতির এক সাংবাদিককে হয়রানি করে। সাংবাদিকের মোবাইল নিয়ে গ্যালারি, মেসেঞ্জার চ্যাক করার পাশাপাশি তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেসাবাদ করা হয়। তাকে কোটা আন্দোলনে উস্কানিদাতা ও নেতৃত্বদাতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে চলে যেতে বলে এবং ছাত্রলীগ তাকে বলে, আজ সাংবাদিকের কোনো কাজ নাই।
এদিকে বেলা ১২টায় তিব্বত-নাবিস্কোতে শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলনে বাধা দিতে লাঠিসোঁটা নিয়ে স্থানীয় অনেক ছাত্রলীগ কর্মী জড়ো হয়। পরে বুটেক্স ছাত্রলীগও সেখানে যায়। আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়। দুপক্ষের সাথে ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী। এতে বুটেক্স ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর একাধিক বাইক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারী বুটেক্স শিক্ষার্থীরা বিকাল ৩টায় ছাত্ররাজনীতি বিরোধী স্লোগান হলে ফিরে আসে।
উক্ত দিনে সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ পদপ্রত্যাশীদের অনেকে ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে বুটেক্স ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির জন্য জমা দেওয়া জীবনবৃত্তান্ত তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে সবসময় থাকবেন বলেও তারা জানান।
এদিকে ঘটে আরেক কান্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টে ছাত্রলীগ নেতার কমেন্টের জেড়ে মাতামাতি শুরু হয়। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতে ‘বুটেক্স ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন’ নামক ফেসবুক গ্রুপে এক শিক্ষার্থী পোস্ট করেন। তাতে উক্ত ব্যাচের কোনো শিক্ষার্থী রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা নেই উল্লেখ করে ক্যাম্পাসে সকল ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে মত প্রকাশ করেন। পোস্টে কমেন্ট করেন এক ছাত্রলীগ নেতা। তাতে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা তৈরি হয়। উক্ত কমেন্টকে হুমকিস্বরূপ আখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ জানান।
ঘটনা প্রবাহে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস দাবিতে ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করেন এবং তাতে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ফিরে যাই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আন্দোলনের দিনে
১৭ জুলাই রোজ বুধবার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও হলগুলো বন্ধের নোটিশ সকালের মধ্যে দেওয়া হলেও বুটেক্সে দেওয়া হয় নি। বেলা ১২টায় একজন সিন্ডিকেট সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় তাঁদের সিন্ডিকেট মিটিং হয় নি এবং তখন পর্যন্ত মিটিং ডাকা হয় নি।
বিকেল ৩টায় বুটেক্স ক্যাম্পাসে যেকোনো ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করে। শুধু যে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ চাচ্ছেন এমন না, অনেক শিক্ষক সেদিন ক্যাম্পাসে উপস্থিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্স রুমে গিয়ে দেখা যায় রুম ভর্তি শিক্ষক। জানা গেলো উক্ত আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকরাও একাত্বতা প্রকাশ করে। প্রায় চল্লিশজন শিক্ষক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে সম্মতি দেন। ক্যাম্পাসে উপস্থিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দাবি একটাই—ছাত্ররাজনীতি যেন বন্ধ হয়। তখনও শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের মাঠে। শিক্ষার্থীরা উক্ত দাবিতে যে একমত তার প্রমাণ হিসেবে কাগজে স্বাক্ষর নিচ্ছেন। এদিকে ক্যাম্পাস বন্ধের বিষয়ে জরুরি সিন্ডিকেট মিটিং শুরু হয়। উক্ত মিটিং শেষে উপাচার্যের কার্যালয়ে আসে শিক্ষার্থীরা। তখন উপাচার্যের কক্ষে ছিলেন চার হলের প্রভোস্ট, একজন সিন্ডিকেট সদস্য এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক। শিক্ষার্থীরা একে-একে তাদের দাবি তুলে ধরেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেসব দাবি ছিলো
(ক) বুটেক্স ক্যাম্পাসে এবং সকল হলসমূহে সকল প্রকার ছাত্ররাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা (খ) কোনো বহিরাগত এবং মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর হলে অবস্থান নিষিদ্ধ করা (গ) সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করা (ঘ) প্রশাসনিকভাবে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের হলের আসন বন্টন ও তিন কর্মদিবসের মধ্যে আবাসিক কার্ড প্রদান করা (ঙ) ক্যান্টিন ও ডাইনিং চালু রাখা এবং খাবারের মান বৃদ্ধি করা (চ) সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটরগণ সর্বদা নিয়োজিত থাকা।
তারপর শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ছয়টি দাবির প্রতিটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে ইঙ্গিত করে। যেসব যৌক্তিকতা শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের নিকট উপস্থাপন করেন। তা হলো—
(ক) কোটা সংস্কারের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি ও হুমকি প্রদান (খ) হলের প্রধান ফটক বন্ধ করে হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে (গ) ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত নেতাকর্মী দ্বারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সরাসরি হুমকি প্রদান (ঘ) ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) রাতে মিথ্যা গজব ছড়ানোর মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করে হল ত্যাগে বাধ্য করা (ঙ) সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক কোটা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে নীতি গর্হিত এবং সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা (চ) শিক্ষার্থীদের ক্লাস-ল্যাব বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন ও ধানমন্ডি-৩২ এ যেতে বাধ্য করা। শিক্ষার্থীরা যেতে বাধা দিলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং মানসিক নির্যাতন করা (ছ) হলে শিক্ষার্থীদের আদব-কায়দার নামে গভীর রাতে ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত নেতাকর্মী দ্বারা অসহনীয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা (জ) হলের ক্যান্টিনের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্রমাগত চাঁদা গ্রহণ, বিভিন্ন সময়ে হলের মাঠে বহিরাগতদের দিয়ে অবাধ প্রবেশাধিকার দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটানো।
ক্যাম্পাস ও হলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ও যৌক্তিকতা উপস্থাপন করার পর উপাচার্য ক্যাম্পাসের রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে তিনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন না জানান। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীরা যদি দাবিগুলো একটু আগে হওয়া সিন্ডিকেট মিটিংয়ের আগে জানাতো তাহলে মিটিংয়ে বলা যেত। আবার মিটিংয়ে নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাদে কোনো বিষয়ে আলোচনা হয় না। সামনের আবার সিন্ডিকেট মিটিং ডেকে এ ব্যাপারে আলোচনা করে জানানো হবে। উপাচার্যের উক্ত কথায় শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু হলে তাৎক্ষণিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদাহরণ উপাচার্যের নিকট বলার পর উপাচার্য বলেন, ক্যাম্পাসের রাজনীতি বন্ধে সিন্ডিকেট মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে হলের রাজনীতির বিষয়ে চাইলে প্রভোষ্টগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
আন্দোলনকারীরা কোনোমতে মানতে পারছিলেন না। তাদের মতে, আজই হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক এবং ক্যাম্পাসের রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত কবে দেওয়া হবে তা জানানো হোক। উপাচার্য তখন উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের বলেন, সিন্ডিকেট মিটিং ডেকে কথা বলে জানানো হবে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে হ্যাঁ বা না—কোনোটার ইঙ্গিত না দিলেও ‘জানানো হবে’ বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
শিক্ষকদের মাঝে ভয়ের ‘নাটকীয়তা’
পরে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কার্যালয় ত্যাগ করেন এবং প্রায় আধা ঘন্টা পর শিক্ষার্থীদের একাংশ শিক্ষক কমনরুমে যান। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, চার হলের হল প্রভোস্ট, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকসহ আরও অনেক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।
উপাচার্যের কক্ষে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মনে আশা কাজ করলেও শিক্ষক কমনরুমে প্রেক্ষাপট বদলাতে থাকে। উপস্থিত শিক্ষকদের মতে, যেসব সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে চাচ্ছে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে সেসব সমস্যা বাড়তে পারে। বুটেক্স তেজগাঁওয়ে অবস্থিত; ক্যাম্পাসের পাশেই ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট। বুটেক্সে রাজনীতি বন্ধ হলে সামনে সমস্যা বাড়তে পারে। পলিটেকনিক ও স্থানীয় ছাত্রলীগের আধিপত্য বা প্রভাব আসতে পারে এবং নিরাপত্তার হুমকি দেখা দিতে পারে। তাছাড়া রাজনীতি বন্ধ করা হলে বুটেক্স ছাত্রলীগ পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এখানে শিক্ষকরা বারবার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয় তুলে ধরেন। তারপরও উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তা মানতে রাজি নন। তাদের মতে, শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তা তারা নিজেরা নিতে পারবে, কেবল ক্যাম্পাস ও হলে নিরাপত্তার দায়িত্ববানদের দিতে হবে।
শিক্ষকরা তখন গত রাতের ঘটনা উল্লেখ করেন। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর আবাসিক শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করে। সন্ধ্যায় সবার মেসেঞ্জারে একটি গুজব ছড়িয়ে পরে। মেসেজে উল্লেখ থাকে, পলিটেকনিক ছাত্রলীগ বুটেক্সের হলগুলোতে হামলা করবে। শিক্ষার্থীরা মেসেজে কিছুটা বিশ্বাস করে আতংকগ্রস্থ হয়ে পরে। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে রাতে প্রক্টরিয়াল বডির মিটিং হয় এবং হলগুলোতে পুলিশ মোতায়েন করে। হল প্রভোস্টগণ পুলিশকে সাথে নিয়ে হলগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে যে হলে হামলা বা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে হল থেকে প্রায় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বাইরে চলে যায়।
পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের হামলার ভয়ে বুটেক্স শিক্ষার্থীরা যদি হল ছেড়ে দেয় তাহলে যদি হল ও ক্যাম্পাসের রাজনীতি বন্ধের পর নিরাপত্তার শংকা দেখা যায় তখন কী হবে! শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কথায় দ্বিমত পোষণ করে হল ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা প্রদান অর্থাৎ শিক্ষকরা যারযার দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। কিন্তু তাতেও শিক্ষকরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধে অস্বীকৃতি জানান।
শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি থাকায় ক্যাম্পাসে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা উপস্থিত শিক্ষকদের বুঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শিক্ষকরা নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে তাতে অস্বীকৃতি জানান। তখন রাত নয়টা বেজে যায় এবং রাত ১০টার মধ্যে হল ছাড়ার নোটিশের ব্যাপারে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বলেন। তাঁরা হলসমূহে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সামনের সপ্তাহের শুরুর দিকে জানানো হবে বলেন এবং বলেন যেন রাত ১০টার মধ্যে সবাই হল ছাড়ে নাহলে নিরাপত্তার আশংকা দেখা দিতে পারে।
এদিকে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা-১ এবং সাতরাস্তায় পনের থেকে বিশজন লাঠিসোঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শোনা যায়। ধারণা করা হয়, ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত আসলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে পারে। যেহেতু নিরাপত্তার আশংকা এবং রাতের মধ্যে হল ছাড়তে হবে, তা শিক্ষার্থীরা চিন্তা করে সামনে আরও রাজনীতি বন্ধের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ক্যাম্পাস ছাড়েন।
দায়িত্ববান শিক্ষকদের কথায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধে যে অনীহা দেখা যায় তাতে তাঁদের পক্ষে নেই সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। যেহেতু সরকারি চাকরি করেন তাই তাদের হাত বাধা এবং নাটকীয় পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে অনেক সাধারণ শিক্ষক মনে করেন, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা তাঁদের স্বার্থ হাসিল করছেন। শিক্ষক নেতারা ‘মুখোশধারী’ উল্লেখ করে কিছু সাধারণ শিক্ষক তাঁদের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার বিষয়ে যদি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ না করা যায় তাহলে এখানে শিক্ষার্থীদের চেয়ে শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে ভয় বেশি বুঝা যাচ্ছে এবং কেন তাঁরা ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। সাধারণ শিক্ষকের অনেকে মনে করেন, নিরাপত্তার বিষয়ে যেহেতু শিক্ষার্থীরা মেনে নিয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা শুধু হল ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা চেয়েছেন তাতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধে আর কোনো প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু দায়িত্ববান শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন।
তবে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আশা করছেন যেহেতু ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হওয়া গেছে তাই সামনে এ আন্দোলন অব্যাহত রাখলে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বিষয়ে পরিবর্তন আসতে পারে।
কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছেন ভিন্ন কিছুর
অনেকে ধারণা করছেন বুটেক্সে ছাত্ররাজনীতি টিকে থাকলেও ছাত্রলীগ আগের মতো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। ছাত্রলীগ যেভাবে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করত সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণে তারা চলবে। প্রশাসনের ‘হাতের মুঠোয়’ রেখে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের চালাবে। যেহেতু ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমর্থন আছে তাতে উক্ত ছাত্ররাজনীতিকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে।
বিভিন্ন আয়োজন বা প্রকল্পে ছাত্রলীগের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যে মনমালিন্য দেখা যায় সামনে হয়তো সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মতো করে হবে।
ছাত্রলীগের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ
বুটেক্স ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী একেএকে সরে আসায় ছাত্রলীগের রাজনীতি করার মত শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে কিনা শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ হতে ৪৯তম ব্যাচ পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায় ৪৫ ও ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা রাজনীতিতে থাকবে এমন সংখ্যা পনের থেকে বিশ জন। ৪৭তম ব্যাচ রাজনীতিতে অংশ নিবে না সাফ জানিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যেহেতু ব্যাচভিত্তিক ধারা বজায় থাকে তাই ৪৭তম ব্যাচের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলে নবীন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে আসবে না। ৪৮ ও ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কেউ রাজনীতিতে অংশ নিবে তা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে।
ফেসবুকে রাজনীতি বিরোধী শতশত পোস্টে রাজনীতির যে দুর্দশা তৈরি হয় তাতে অনেকে মনে করছেন বর্তমান সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক রাজনীতির ধারা ফিরে আনতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। ছাত্রলীগের এ কমিটি সাংগঠনিক কোনো মিটিং না হওয়া এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাদে বাকি পদগুলো অকার্যকর করার অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতারা করে অনেকে বলছেন এ কমিটি শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছু করে নি। শিক্ষার্থীদের মতে, বুটেক্স ছাত্রলীগ আর্থিক লাভের যেসব খাত আছে সেসবে কাজ করেছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। শিক্ষার্থীরা যেভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলো তাতে অনেকের মুখে বর্তমান কমিটিকে অবাঞ্চিত করার ঘোষণাও আসতে পারে এমন গুঞ্জন শুনা যায়। তবে এতকিছুর পরও এসবের গ্লানি মুছে সব ভুলে নতুন উদ্দ্যমে কাজ করার প্রয়াসের কথা ব্যক্ত করেছেন সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ।
মাহবুব আলম রিয়াজ
ক্যাম্পাস সাংবাদিক ও লেখক
সভাপতি, বুটেক্স সাংবাদিক সমিতি
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)