০৫:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশি গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার শিকার যবিপ্রবির যেসকল শিক্ষার্থী

ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত: ০৫:৩১:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / 25

যবিপ্রবি প্রতিনিধি:

আন্দোলনের একপর্যায়ে সেসময়ের ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সশস্ত্র হামলা ও পুলিশের গুলি আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটে ঢাকা,চট্টগ্রাম, রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। জোরদার হয় ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ঘোষণায় রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হয় শেখ হাসিনার সরকার, পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় র্যাব, বিজিবি ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। শুরু হয় নির্বিচারে গুলি, গণগ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার কারসাজি। এরপর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে দু’দফায় কারফিউ জারি করা হয়। কোটা সংস্কারের রূপ নেয় শেখ হাসিনার পদত্যাগের আন্দোলনে, ৫ আগস্ট দুপুরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী আহত-নিহতের সংখ্যা যেমন অনিশ্চিত তেমনি গ্রেফতার ও মামলার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যাটাও অগণিত। আন্দোলনকালীন সময়ে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের(যবিপ্রবি) একাধিক শিক্ষার্থী। আজ সেসব শিক্ষার্থীদের থেকেই শুনবো আন্দোলনকালীন সময়ে তাঁদের সাথে কি কি ঘটেছিলো?

কেমিকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো: আকিবুল ইসলাম বলেন, ফরিদপুর জেলার অন্যতম সমন্বয়ক ছিলো আমার ছোটভাই তাকবির। মিছিলে সামনের সারিতে থাকার ছবি দেখে পুলিশ ওকে শনাক্ত করে, পরবর্তীতে ফেসবুকের পোস্ট দেখে পুলিশ ওরে গ্রেফতার করে। ছোটভাইকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আমি ওকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করি। মূহুর্তের মধ্যে পোস্টটি অনেক শেয়ার হয়ে যায় এবং পুলিশের নজরে এলে আমার আইডি ও ছবি দেখিয়ে তাকবিরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে পুলিশ। ও সব সত্য কথা বলে, পুলিশ জিজ্ঞাসা করে আমি ঢাকায় আন্দোলনে গিয়েছিলাম নাকি! তারপর আমার বিস্তারিত তথ্য নেয় ওর থেকে। একথা জানতে পেরে পরিবার আমাকে যশোর থেকে চলে যেতে বলে, পুলিশ যেকোনো সময় গ্রেফতার করবে। অনেক ভেবে দেখি যশোর থেকে পুলিশ ধরলে ক্যাম্পাসের শিক্ষক এবং ছাত্রদের একটা সাপোর্ট পাবো। তাই যশোরেই অন্য একটা বন্ধুর মেসে থেকে আন্দোলন করতে থাকি। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৬ আগস্ট রাতে বাড়ি যায়। পরদিন জানতে পারি আমার নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, ৮ তারিখে হাজিরা দিতে হবে। যথারীতি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিয়েছিলাম, শুধু তাই নয় আমার সেই ছোট ভাইকে ৩১ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট সাতটা দিন জেলে কাটাতে হয়েছে। এখন ধরেন এই সরকারের পতন না হইতো, তাইলে এই পুলিশ আমাকে কি করতো! রিমান্ড, জেল বা যেকোনো কিছুই হতে পারতো। যেখানে আমি জানিই না কি এবং কেন মামলা দেওয়া হয়ছে। দোষ শুধু এতটুকুই যে সরকারের বিপক্ষে গিয়ে আন্দোলন করেছি। আল্লাহর কাছে লাখোকোটি শুকরিয়া তিনি আমাদের জালিম সরকারের থেকে রক্ষা করেছেন।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএস) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোয়াজ বিন সাইফুল বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের সময় মিছিল আমার এলাকা কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের কলেজ “মাহতাবউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ” আসে। কলেজে মিছিল ঢুকেছিলো মেইন গেট দিয়ে, আমি ইজিবাইক দিয়ে আসছিলাম। সেকেন্ড গেটের কাছে পুলিশ ছিলো, আমার ইজিবাইক আবার সেকেন্ড গেইট দিয়েই যাচ্ছিলো। সেকেন্ড গেট দিয়ে মিছিলে ঢুকতে গেছি, ঐ সময় ইজিবাইক থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। আমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়ার পর তাঁরা আমাকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়। এরপর ৪ ঘন্টা মতো হাজতে ছিলাম। ঘটনা জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠীরা স্যারেদের নজরে আনলে স্যারেরা হেল্প করেছিলো। ছাত্র পরামর্শ দপ্তরের কিবরিয়া স্যার হেল্প করেছিলো এতটুক জানি, বাকি স্যারদের নাম জানিনা। থানা থেকে বের হয়ে রিক্সায় আসার সময় আব্বু বলছিলেন- তুই আন্দোলন করে মরে গেলে আমি শহীদের বাপ হিসেবে গর্ববোধ করতাম। ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে যে যেখান থেকে চেষ্টা করেছিলেন।

টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জোবায়ের মাহবুব বলেন, ২৯ জুলাই পালবাড়ি থেকে যশোর প্রেসক্লাবের সামনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে ইজিবাইকে করে যাওয়ার পথে চুয়াডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছালে পুলিশ ইজিবাইক থামিয়ে আমাদের পরিচয় ও গন্তব্য জানতে চায়। আমাদের উদ্দেশ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় জানতে পেরে পুলিশ সদস্যরা রাস্তার পাশের একটি দোকানের ভেতর নিয়ে আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, বিভিন্নধরনের রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে বাজেভাবে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই গণিত বিভাগের এক সিনিয়র ভাইকেও আটক করে নিয়ে আসে। ১৫-২০ মিনিট পর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসলে গণিত বিভাগের সিনিয়র ভাইকে ছেড়ে দিলেও অ্যাকাউন্টিং বিভাগের ৩জন ও আমি সহ ৪ জনকে ডিবির গাড়ি করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাদেরকে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এক পর্যায়ে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের প্রত্যেকের একজন করে অভিভাবক নিয়ে আসলে মুচলেকার মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে সন্ধ্যার সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৭ জনের একটি প্রতিনিধি দল আসলে রাত ৮:০০ সময় ডিবি অফিস থেকে ছাড়ে। ছাড়ার সময় ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, একদিনের মধ্যেই যেনো যশোর ত্যাগ করি ও পরবর্তীতে আন্দোলনে যোগ দিলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে শিক্ষকগণ ডিবি অফিস থেকে বের করে পালবাড়ি আমাদের মেসের নিকট পৌঁছে দেন ও বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মো: সিফাতুর রহমান বলেন, গত ৩০শে জুলাই বিকালবেলা আমি ও আমার তিন বন্ধু মিলে আমাদের মাগুরা মডেল স্কুলের দেয়ালে গ্রাফিতি করতেছিলাম। কিন্তু স্কুল মাঠ থেকে একজন আমাদের দেখে পুলিশকে খবর দেয়। আমরা তা বুঝতে পারিনি, এরপর আমরা সরকারি কলেজের ভিতর যায়।সেখানে কিছু ছাত্রলীগের পদধারী সদস্যরা আগেই খবর পেয়ে আমাদের ধরে কলেজের ভিতর আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পর ডিবি পুলিশ এসে আমাদের ফোন চেক করে গ্রাফিতি করার ছবি পেয়ে আমাদের চারজনকে আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায় এবং সেখানে আমাদের মারধর করা হয়। এরপর CCIC তে আমাদের ফোনগুলো পরীক্ষা করে কোনো সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতা পাইনা।রাতে আমাদের এসপির রুমে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে এসপি ও এএসপি(ক্রিমিনাল )সহ পুলিশের অনেকে ছিল।মজার ব্যাপার হলো আমাদেরকে দেয়াল লিখনের কারণে আটক করে এএসপি আমাদের জিজ্ঞেস করে ‘স্বাধীনতা বলতে তুমি কি বুঝ?’।আমার শহরের আইন শৃঙ্খলার সর্বোচ্চ পদে বসে তাদের ঐ আচরণে আমি বিষ্মিত ও ব্যথিত হই। দলীয় লেজুড়বৃত্তির চুড়ান্ত উদাহরণ সেদিন আমরা দেখি। তাদের মুখে ছিল মেট্রোরেল আর বিটিভি অফিস পোড়ানোর দুঃখগাঁথা। এত ছাত্রদের মৃত্যু ছিল তাদের কাছে ন্যায়। এমনকি আমরা যখন বললাম যে শিশুগুলো গুলি খেয়ে মরলো তাদের কি দোষ ছিল! উত্তরে এসপি যে ভয়ংকর নির্লিপ্ততা নিয়ে এটাকে ‘কোল্যাটারাল ড্যামাজ’ বলে অ্যাখ্যায়িত করলো তা আমি কখনো ভুলবো না।এরকম একজন মানুষের কাছে দেশের কোনো জেলার আইন শৃঙ্খলা, আমার সংবিধান ও সে শহরের মানুষের জীবন নিরাপদ না।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সিফাত আরো বলেন, এসপি বলে এদের নিয়ে রেইড দেও,যদি ওরা গুলি চালাই তাহলে সবাইকে একসাথে গুলি করে দিবা। তারপর থানার গারদে রাখে, পরদিন বিকালে মামলা দিয়ে কোর্টে পাঠানো হয়।সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং আজগুবি মামলা দিয়ে আমাদের জেলে পাঠানো হয়। আমারে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় অনেক কান্না করতেছিল আম্মু। জেলে যাওয়ার পর আন্দোলনের দিন গ্রেফতার হওয়া অন্য ছাত্রদের সাথে দেখা হয়। আমি যে ৬দিন ছিলাম তার পাঁচদিনই জেলে পানি ছিল না। বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ৬ দিন জেলে ছিলাম। কারারক্ষীদের কাছে খবর পেতাম বাইরে অনেক আন্দোলন হচ্ছে। তাই নিয়ে আলোচনা চলত সারাদিন। মজা করে মুন্নারে বলতাম সরকার পতন হলে একমাস এক্সট্রা জেল খাটতিও কোনো আপত্তি নেই। জেলের ভেতরের অসংখ্য নিরিহ আর নিরপরাধ মানুষের দিকে তাকালেই বুঝতাম এসব মানুষের অভিশাপ বৃথা যাবে না।রবিবার আমাদের মামলা শুনলাম কোর্টে তুলছে, সারাদিন অপেক্ষা করার পর ও ওইদিন আমাদের জামিন হয়না। পরে জানতে পারি ওইদিন আমাদের জামিন হলেও আমাদের ছাড়া হয়নি। পরদিন সোমবার বিকালে স্বাধীন দেশে আমরা মুক্তি পাই।আমার ওয়ার্ডের সামনের রজনীগন্ধার গাছগুলোতে নিয়মিত পানি দিতাম আমি, অনেক সুন্দর ফুল ছিল। আসার সময় নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু মুক্তির আনন্দে তুচ্ছ ফুলগুলোর দিকে আর নজর যায়নি।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএস) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রবিন হোসেন বলেন, ৯ শে জুলাই বিকাল তিনটায় নয় দফার দাবিতে যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সামনে বিক্ষোভ মিছিল ছিলো। আমি সহ আরো তিনজন কর্মসূচিতে যাচ্ছিলাম, চুয়াডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের ইজিবাইক আটকায় এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠিয়ে আমাদেরকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও রুমের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমাদের নানানভাবে হেনস্তা করতে থাকে। সন্ধ্যার পর কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত হয়, তাদের সামনে বলে পরবর্তীতে আমরা যদি আন্দোলনে আসি তবে তারা আমাদেরকে পুনরায় আটক করবে এবং মামলা দায়েরসহ কঠোরতম আইনানুগ ব্যবস্থা নিবে। এরপর আমাদের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে স্যারদের হেফাজতে দেয়। সেদিন আমার সাথে আমার বন্ধু ইমরান হোসেন ও সাগর হোসেনকেও একই ভাবে হেনস্তা ও হয়রানি করেছিলো যশোরের পুলিশরা।

এমন আরো ঘটনা ঘটেছে বিপ্লবী জুলাইয়ে, যার সাক্ষী আপনি আমি ও আমরা। পর্যায়ক্রমে আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে সেসকল নির্যাতনের কথা।

শেয়ার করুন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশি গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার শিকার যবিপ্রবির যেসকল শিক্ষার্থী

প্রকাশিত: ০৫:৩১:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

যবিপ্রবি প্রতিনিধি:

আন্দোলনের একপর্যায়ে সেসময়ের ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সশস্ত্র হামলা ও পুলিশের গুলি আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটে ঢাকা,চট্টগ্রাম, রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। জোরদার হয় ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ঘোষণায় রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হয় শেখ হাসিনার সরকার, পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় র্যাব, বিজিবি ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। শুরু হয় নির্বিচারে গুলি, গণগ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার কারসাজি। এরপর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে দু’দফায় কারফিউ জারি করা হয়। কোটা সংস্কারের রূপ নেয় শেখ হাসিনার পদত্যাগের আন্দোলনে, ৫ আগস্ট দুপুরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী আহত-নিহতের সংখ্যা যেমন অনিশ্চিত তেমনি গ্রেফতার ও মামলার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যাটাও অগণিত। আন্দোলনকালীন সময়ে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের(যবিপ্রবি) একাধিক শিক্ষার্থী। আজ সেসব শিক্ষার্থীদের থেকেই শুনবো আন্দোলনকালীন সময়ে তাঁদের সাথে কি কি ঘটেছিলো?

কেমিকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো: আকিবুল ইসলাম বলেন, ফরিদপুর জেলার অন্যতম সমন্বয়ক ছিলো আমার ছোটভাই তাকবির। মিছিলে সামনের সারিতে থাকার ছবি দেখে পুলিশ ওকে শনাক্ত করে, পরবর্তীতে ফেসবুকের পোস্ট দেখে পুলিশ ওরে গ্রেফতার করে। ছোটভাইকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আমি ওকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করি। মূহুর্তের মধ্যে পোস্টটি অনেক শেয়ার হয়ে যায় এবং পুলিশের নজরে এলে আমার আইডি ও ছবি দেখিয়ে তাকবিরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে পুলিশ। ও সব সত্য কথা বলে, পুলিশ জিজ্ঞাসা করে আমি ঢাকায় আন্দোলনে গিয়েছিলাম নাকি! তারপর আমার বিস্তারিত তথ্য নেয় ওর থেকে। একথা জানতে পেরে পরিবার আমাকে যশোর থেকে চলে যেতে বলে, পুলিশ যেকোনো সময় গ্রেফতার করবে। অনেক ভেবে দেখি যশোর থেকে পুলিশ ধরলে ক্যাম্পাসের শিক্ষক এবং ছাত্রদের একটা সাপোর্ট পাবো। তাই যশোরেই অন্য একটা বন্ধুর মেসে থেকে আন্দোলন করতে থাকি। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৬ আগস্ট রাতে বাড়ি যায়। পরদিন জানতে পারি আমার নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, ৮ তারিখে হাজিরা দিতে হবে। যথারীতি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিয়েছিলাম, শুধু তাই নয় আমার সেই ছোট ভাইকে ৩১ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট সাতটা দিন জেলে কাটাতে হয়েছে। এখন ধরেন এই সরকারের পতন না হইতো, তাইলে এই পুলিশ আমাকে কি করতো! রিমান্ড, জেল বা যেকোনো কিছুই হতে পারতো। যেখানে আমি জানিই না কি এবং কেন মামলা দেওয়া হয়ছে। দোষ শুধু এতটুকুই যে সরকারের বিপক্ষে গিয়ে আন্দোলন করেছি। আল্লাহর কাছে লাখোকোটি শুকরিয়া তিনি আমাদের জালিম সরকারের থেকে রক্ষা করেছেন।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএস) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোয়াজ বিন সাইফুল বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের সময় মিছিল আমার এলাকা কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের কলেজ “মাহতাবউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ” আসে। কলেজে মিছিল ঢুকেছিলো মেইন গেট দিয়ে, আমি ইজিবাইক দিয়ে আসছিলাম। সেকেন্ড গেটের কাছে পুলিশ ছিলো, আমার ইজিবাইক আবার সেকেন্ড গেইট দিয়েই যাচ্ছিলো। সেকেন্ড গেট দিয়ে মিছিলে ঢুকতে গেছি, ঐ সময় ইজিবাইক থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। আমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়ার পর তাঁরা আমাকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়। এরপর ৪ ঘন্টা মতো হাজতে ছিলাম। ঘটনা জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠীরা স্যারেদের নজরে আনলে স্যারেরা হেল্প করেছিলো। ছাত্র পরামর্শ দপ্তরের কিবরিয়া স্যার হেল্প করেছিলো এতটুক জানি, বাকি স্যারদের নাম জানিনা। থানা থেকে বের হয়ে রিক্সায় আসার সময় আব্বু বলছিলেন- তুই আন্দোলন করে মরে গেলে আমি শহীদের বাপ হিসেবে গর্ববোধ করতাম। ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে যে যেখান থেকে চেষ্টা করেছিলেন।

টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জোবায়ের মাহবুব বলেন, ২৯ জুলাই পালবাড়ি থেকে যশোর প্রেসক্লাবের সামনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে ইজিবাইকে করে যাওয়ার পথে চুয়াডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছালে পুলিশ ইজিবাইক থামিয়ে আমাদের পরিচয় ও গন্তব্য জানতে চায়। আমাদের উদ্দেশ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় জানতে পেরে পুলিশ সদস্যরা রাস্তার পাশের একটি দোকানের ভেতর নিয়ে আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, বিভিন্নধরনের রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে বাজেভাবে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই গণিত বিভাগের এক সিনিয়র ভাইকেও আটক করে নিয়ে আসে। ১৫-২০ মিনিট পর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসলে গণিত বিভাগের সিনিয়র ভাইকে ছেড়ে দিলেও অ্যাকাউন্টিং বিভাগের ৩জন ও আমি সহ ৪ জনকে ডিবির গাড়ি করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাদেরকে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এক পর্যায়ে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের প্রত্যেকের একজন করে অভিভাবক নিয়ে আসলে মুচলেকার মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে সন্ধ্যার সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৭ জনের একটি প্রতিনিধি দল আসলে রাত ৮:০০ সময় ডিবি অফিস থেকে ছাড়ে। ছাড়ার সময় ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, একদিনের মধ্যেই যেনো যশোর ত্যাগ করি ও পরবর্তীতে আন্দোলনে যোগ দিলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে শিক্ষকগণ ডিবি অফিস থেকে বের করে পালবাড়ি আমাদের মেসের নিকট পৌঁছে দেন ও বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মো: সিফাতুর রহমান বলেন, গত ৩০শে জুলাই বিকালবেলা আমি ও আমার তিন বন্ধু মিলে আমাদের মাগুরা মডেল স্কুলের দেয়ালে গ্রাফিতি করতেছিলাম। কিন্তু স্কুল মাঠ থেকে একজন আমাদের দেখে পুলিশকে খবর দেয়। আমরা তা বুঝতে পারিনি, এরপর আমরা সরকারি কলেজের ভিতর যায়।সেখানে কিছু ছাত্রলীগের পদধারী সদস্যরা আগেই খবর পেয়ে আমাদের ধরে কলেজের ভিতর আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পর ডিবি পুলিশ এসে আমাদের ফোন চেক করে গ্রাফিতি করার ছবি পেয়ে আমাদের চারজনকে আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায় এবং সেখানে আমাদের মারধর করা হয়। এরপর CCIC তে আমাদের ফোনগুলো পরীক্ষা করে কোনো সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতা পাইনা।রাতে আমাদের এসপির রুমে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে এসপি ও এএসপি(ক্রিমিনাল )সহ পুলিশের অনেকে ছিল।মজার ব্যাপার হলো আমাদেরকে দেয়াল লিখনের কারণে আটক করে এএসপি আমাদের জিজ্ঞেস করে ‘স্বাধীনতা বলতে তুমি কি বুঝ?’।আমার শহরের আইন শৃঙ্খলার সর্বোচ্চ পদে বসে তাদের ঐ আচরণে আমি বিষ্মিত ও ব্যথিত হই। দলীয় লেজুড়বৃত্তির চুড়ান্ত উদাহরণ সেদিন আমরা দেখি। তাদের মুখে ছিল মেট্রোরেল আর বিটিভি অফিস পোড়ানোর দুঃখগাঁথা। এত ছাত্রদের মৃত্যু ছিল তাদের কাছে ন্যায়। এমনকি আমরা যখন বললাম যে শিশুগুলো গুলি খেয়ে মরলো তাদের কি দোষ ছিল! উত্তরে এসপি যে ভয়ংকর নির্লিপ্ততা নিয়ে এটাকে ‘কোল্যাটারাল ড্যামাজ’ বলে অ্যাখ্যায়িত করলো তা আমি কখনো ভুলবো না।এরকম একজন মানুষের কাছে দেশের কোনো জেলার আইন শৃঙ্খলা, আমার সংবিধান ও সে শহরের মানুষের জীবন নিরাপদ না।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সিফাত আরো বলেন, এসপি বলে এদের নিয়ে রেইড দেও,যদি ওরা গুলি চালাই তাহলে সবাইকে একসাথে গুলি করে দিবা। তারপর থানার গারদে রাখে, পরদিন বিকালে মামলা দিয়ে কোর্টে পাঠানো হয়।সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং আজগুবি মামলা দিয়ে আমাদের জেলে পাঠানো হয়। আমারে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় অনেক কান্না করতেছিল আম্মু। জেলে যাওয়ার পর আন্দোলনের দিন গ্রেফতার হওয়া অন্য ছাত্রদের সাথে দেখা হয়। আমি যে ৬দিন ছিলাম তার পাঁচদিনই জেলে পানি ছিল না। বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ৬ দিন জেলে ছিলাম। কারারক্ষীদের কাছে খবর পেতাম বাইরে অনেক আন্দোলন হচ্ছে। তাই নিয়ে আলোচনা চলত সারাদিন। মজা করে মুন্নারে বলতাম সরকার পতন হলে একমাস এক্সট্রা জেল খাটতিও কোনো আপত্তি নেই। জেলের ভেতরের অসংখ্য নিরিহ আর নিরপরাধ মানুষের দিকে তাকালেই বুঝতাম এসব মানুষের অভিশাপ বৃথা যাবে না।রবিবার আমাদের মামলা শুনলাম কোর্টে তুলছে, সারাদিন অপেক্ষা করার পর ও ওইদিন আমাদের জামিন হয়না। পরে জানতে পারি ওইদিন আমাদের জামিন হলেও আমাদের ছাড়া হয়নি। পরদিন সোমবার বিকালে স্বাধীন দেশে আমরা মুক্তি পাই।আমার ওয়ার্ডের সামনের রজনীগন্ধার গাছগুলোতে নিয়মিত পানি দিতাম আমি, অনেক সুন্দর ফুল ছিল। আসার সময় নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু মুক্তির আনন্দে তুচ্ছ ফুলগুলোর দিকে আর নজর যায়নি।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএস) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রবিন হোসেন বলেন, ৯ শে জুলাই বিকাল তিনটায় নয় দফার দাবিতে যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সামনে বিক্ষোভ মিছিল ছিলো। আমি সহ আরো তিনজন কর্মসূচিতে যাচ্ছিলাম, চুয়াডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের ইজিবাইক আটকায় এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠিয়ে আমাদেরকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও রুমের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমাদের নানানভাবে হেনস্তা করতে থাকে। সন্ধ্যার পর কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত হয়, তাদের সামনে বলে পরবর্তীতে আমরা যদি আন্দোলনে আসি তবে তারা আমাদেরকে পুনরায় আটক করবে এবং মামলা দায়েরসহ কঠোরতম আইনানুগ ব্যবস্থা নিবে। এরপর আমাদের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে স্যারদের হেফাজতে দেয়। সেদিন আমার সাথে আমার বন্ধু ইমরান হোসেন ও সাগর হোসেনকেও একই ভাবে হেনস্তা ও হয়রানি করেছিলো যশোরের পুলিশরা।

এমন আরো ঘটনা ঘটেছে বিপ্লবী জুলাইয়ে, যার সাক্ষী আপনি আমি ও আমরা। পর্যায়ক্রমে আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে সেসকল নির্যাতনের কথা।