বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই বৈষম্যমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা
- প্রকাশিত: ০২:৩৯:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / 120
বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে এদেশের বুকে নেমে আসে জুলাই বিপ্লব ২০২৪ । এবার সময় এসেছে হাজার শহিদ আর আহত যোদ্ধার লালিত স্বপ্ন “বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ” গড়ে তুলবার। সেই যাত্রায় বৈষম্যমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নই হতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। বলা হয় “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”। শিক্ষিত জাতিই পারে একটি দেশকে সমৃদ্ধির চরম শেখরে পৌছে নিয়ে যেতে। তবে দু:খজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে পরিকল্পিত শিক্ষা ও শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে বরাবরই ব্যর্থ।
১৯৭২ সালে করা হয় প্রথম “জাতীয় শিক্ষা কমিশন” ; পরবর্তীতে বিভিন্ন আরো ৬ টি শিক্ষা কমিশন গঠন হলেও শিক্ষার সত্যিকারের সুফল পাওয়া থেকে জাতি বঞ্চিত আজও। শিক্ষার সুযোগ গ্রহণে শহর-গ্রামের পার্থক্য, পরিবারের অর্থনৈতিক পার্থক্য , প্রান্তিক ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কিংবা লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের কারণে বৈষম্য যেন পিছু ছাড়ছে না। এছাড়াও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে রাষ্ট্রের অবহেলাই প্রমাণ করে আমাদের শিক্ষাখাত ঠিক কতটা বৈষম্যযুক্ত। দেশের সব ধরনের জনগোষ্ঠীকে সম্পদে রূপান্তর করতে বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই । উইকিপিডিয়ার মতে শিক্ষায় বৈষম্য হল, “শিক্ষার পূর্ণ অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জনসংখ্যার অন্তর্গত লোকেদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ”। শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নে উল্লেখিত সকল কারণ সমাধান করে শিক্ষার সুযোগে সমতা নিশ্চিতই বৈষম্যমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা ।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসেও আমরা একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারি নি। পরতে পরতে বৈষম্য, অসমতা যেন জাতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে বারংবার। শহরে উচ্চ মূল্যের শিক্ষা; গ্রামে শিক্ষার দৈন্যদশা দিনে দিনে বাড়ছে। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের অভাব ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ পরবর্তী ক্লাসরুমে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা ভোগাচ্ছে গ্রামীণ শিক্ষা কার্যক্রমকে। অন্যদিকে শহরে শিক্ষার ব্যয় বেড়ে আকাশচুম্বি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শহর ও গ্রামের পার্থক্য পিছিয়ে দিচ্ছে বহু শিক্ষার্থীর স্বপ্নযাত্রাকে। শহর ও গ্রামের এই পার্থক্য ঘোচাতে অবিলম্বে শিক্ষার বাণিজ্যিকীরণ কে রোধ করতে হবে। ব্রহ্মপুত্রের বালুচরে বড় হওয়া একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভ করা তার মানবাধিকার; যেমন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে শহরের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত অন্য একজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার সুযোগ গ্রহণে ছেলে ও মেয়ের মধ্যকার পার্থক্য কমতে শুরু করলেও এখনো চূড়ান্ত সফলতার মুখ দেখে নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রামীণ শিক্ষার বেহাল দশায় মুকুলেই ঝড়ে যায় অনেকে; অন্যদিকে শহরমুখী হয়ে শিক্ষার সমস্ত খরচ ও শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানো একেকটি পরিবারের জন্য কঠিন। যার ফলে দরিদ্র ও গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ছেড়ে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হওয়ার প্রবনতা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রমবর্ধমান আবেদন ও ভর্তি ফী, সেমিস্টার ফী সহ হলের খরচ কিংবা হল সংকটের কারণে ব্যাচেলর বাসা বা মেস এ থাকার খরচ যোগাতে নিয়মিত টিউশন পেশা বা বিভিন্ন পার্ট টাইম জব করতে হচ্ছে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের। এতে করে গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষার সত্যিকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শহরে লিঙ্গ বৈষম্য কমে যেতে থাকলেও; গ্রামে এখনো মেয়েরা শিক্ষার সুযোগের সবটুকু পাচ্ছে না। রাষ্ট্র কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা না বাড়ালে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ অচিরেই ঝড়ে যাবে। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষক হলো জাতি গঠনের কারিগর। তবে বাংলাদেশে শিক্ষকদেরই বেঁচে থাকতে হয় সবচেয়ে মানবেতর জীবন নিয়ে। এছাড়াও শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা কম হওয়া ও অপরিকল্পিত অনার্স-মাস্টার্স চালু করায় তৈরি হচ্ছে বেকার জনগোষ্ঠী।
আমাদের হাজার বছরের সংগ্রামে যখনই বৈষম্য হানা দিয়েছে আমরা জেগে উঠেছি, লড়াই করেছি শত বঞ্চনার বিরুদ্ধে।জুলাইয়ের বাংলাদেশে দ্রুত শিক্ষা সংস্কার করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। স্থায়ী শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করে শিক্ষার সুযোগে সমতা বাস্তবায়ন করতে হবে৷ শহর ও গ্রামের পার্থক্য ঘোচাতে সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা উপকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। দরিদ্র ও প্রান্ত্রিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে আর্থিক সহযোগিতা বাড়িয়ে শিক্ষা লাভের পথ সুগম করতে হবে৷ সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে নিয়মিত সভা সেমিনার করে নারী-পুরুষের শিক্ষা অর্জন সহজ করতে হবে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো ও শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফী সহ অন্যান্য খরচ কমিয়ে উচ্চ শিক্ষায় সরকারি সহযোগিতা বাড়াতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার কর্তৃক প্রচলিত ভ্যাট ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ দ্রুত হ্রাস করতে। সামাজিক সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার আধুনিকীকরণ বাধ্যবাধকতামূলক। দক্ষতা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে শত শহিদের স্বপ্নের বৈষম্যহীন ভবিষ্যত গঠনে বৈষম্যমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু এখন সময়ের দাবী।
-হামীম আল ফুয়াদ
সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম – বিইউপি