০৫:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেইসের আদ্যোপান্ত

ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত: ০২:১৪:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪
  • / 49

প্রযুক্তির বিবর্তন কে আমরা সাধারণত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি । প্রথম পর্যায়টি হলো প্রুফ-অব-কনসেপ্ট (Proof-of-Concept), যেখানে একটি প্রযুক্তির মৌলিক কার্যকারিতা প্রদর্শন হয়। এই পর্যায়ে, কার্যক্ষমতাসম্পন্ন সিস্টেমগুলোও অত্যন্ত প্রভাবশালী এমন কি সামান্য কল্পনাকে তাড়িত করে । আর এই কারনেই প্রাথমিক ভাবে এগুলাকে ভুল বুঝে । উদাহরণস্বরূপ, যখন প্রথমবারের মতো মুভিং পিকচার বা চলমান ছবি তৈরি করা হয়েছিল, তখন মানুষ ফুলের দুলুনি বা সমুদ্রতীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার মতো সহজ ভিডিও ফুটেজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তেমনি, যখন কম্পিউটার মাউস প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল, মানুষ ছোট্ট একটি যন্ত্রকে টেবিলের উপর অল্প দূরত্বে সরিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে একটি পয়েন্টারকে দুই মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করার ধারণা নিয়ে বিস্মিত হয়েছিল। মস্তিষ্কের সংকেত ব্যবহার করে যেকোনো তথ্য সরাসরি মস্তিষ্ক থেকে আহরণ করতে পারার ক্ষমতা এই পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে সাধারণ পেশী সঞ্চালন প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো ইমুলেশন (Emulation), যেখানে প্রযুক্তিটি মূলত বিদ্যমান প্রযুক্তিগুলোর কার্যকারিতা নকল করার জন্য ব্যবহৃত হয় যেমন আমরা যদি দেখি যে প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলো ছিলো সাধারণত মঞ্চনাটকের রেকর্ড করা সংস্করণ । আর কম্পিউটার মাউস ব্যবহার করা হতো তালিকা থেকে আইটেম নির্বাচন করতে, ঠিক যেমনটা কিবোর্ডের নিউমেরিক প্যাড দিয়ে করা যেত। সবশেষে, প্রযুক্তিটি যখন তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন এটি নিজস্ব পরিপক্কতা লাভ করে। এই পর্যায়ে, ডিজাইনাররা নতুন প্রযুক্তির সূক্ষ্মতা বুঝতে ও কাজে লাগাতে শুরু করেন এবং এমন অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করেন, যা আগে কখনোই সম্ভব ছিল না।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ কল্পনা করে আসছিলো যে এমন একটা যন্ত্র তৈরি করার যা মানুষ চিন্তা করে যন্ত্রের সাথে যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া করতে পারে । এবং যা মানুষের মনের ভেতর উঁকি দিতে পারে এবং চিন্তাধারার অন্তর্নিহিত ভাবনা জানতে পারে। এই ধারণাগুলো প্রাচীন মিথ এবং আধুনিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মাধ্যমে মানবজাতির কল্পনাকে আকৃষ্ট করেছে। তবে, এটি কেবল সাম্প্রতিক সময়েই সম্ভব হয়েছে, যখন কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স এবং ব্রেইন ইমেজিং প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে আমরা সরাসরি মানব মস্তিষ্কের সাথে ইন্টারফেস করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। এই সক্ষমতা সম্ভব হয়েছে সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে, যা মস্তিষ্কের ভেতরে ঘটে যাওয়া কিছু শারীরিক প্রক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে, যেগুলো নির্দিষ্ট ধরণের চিন্তার সাথে সম্পর্কিত। আর এই প্রযুক্তি কে বলা হয় ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস যাকে সংক্ষেপে (BCI ) বলে । BCI এমন এক ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা যা মস্তিষ্কের সাধারণ আউটপুট পথ, যেমন পেরিফেরাল নার্ভ এবং পেশির ওপর নির্ভর করে না। এই ব্যবস্থায়, ব্যবহারকারীরা কম্পিউটার বা কমিউনিকেশন ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে হাত এবং যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপের মাধ্যমে সংকেত তৈরি করে।
প্রথমে আমরা BCI প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু আলোচনা করি , Brain-Computer Interface (BCI)-এর ইতিহাস অনেকটাই বিজ্ঞানের ফ্রন্টিয়ারে অবস্থান করে। যদিও এটি আধুনিক যুগের একটি প্রযুক্তি, এর পিছনে গবেষণা ও উন্নয়নের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । ১৯২৪ সালের দিকে জার্মান বিজ্ঞানী হ্যান্স বার্গার (Hans Berger) প্রথমবারের মতো মানুষের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ রেকর্ড করতে সক্ষম হন। তিনি এটির নাম দেন Electroencephalography (EEG)।যা কোনো প্রাণীর মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগন্যাল রেকর্ড করার প্রক্রিয়া। আর এর মাধ্যমেই তিনি ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস এর মূল ভিত্তি স্থাপন করেন । আর কিছুদিন পরে ১৯৬০ এর দশকে একজন বিখ্যাত নিউরোসায়েন্টিস্ট জোসে ডেলগাডো (José Delgado) প্রথম মস্তিষ্কে সরাসরি বৈদ্যুতিক উদ্দীপনার মাধ্যমে আচরণ পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। ডেলগাডোর গবেষণা দেখায় যে মস্তিষ্কের সংকেতগুলি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণীদের আচরণ পরিবর্তন করা সম্ভব। যদিও এই গবেষণা অনেক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, তারপরেও এটি BCI-এর বিকাশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসাবে কাজ করে ছিল। এর পর ১৯৭০ এর দশকে Jacques J. Vidal নামের এক গবেষক প্রথমবারের মতো “Brain-Computer Interface” শব্দটি ব্যবহার করেন শুধু তাই নয় ১৯৭৩ সালের দিকে তিনি এক গবেষণায় দেখান যে কিভাবে EEG ব্যবহার করে সরাসরি মস্তিষ্কের সংকেত থেকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর মাধ্যমে Brain-Computer Interface প্রাথমিক পথ উন্মুক্ত হয় । এর ১৯৯০ এর দশকে BCI গবেষণা মূলত ফোকাস করে ননইনভেসিভ (Non-invasive) পদ্ধতির উপর, যেখানে মস্তিষ্কের সংকেতগুলি স্ক্যাল্পের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়। মস্তিষ্ক থেকে সংগ্রহকৃত EEG সংকেতগুলিকে আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ এবং প্রসেস করার জন্য উন্নত অ্যালগরিদম এবং কম্পিউটার প্রসেসিং শক্তির উন্নতি ঘটে। এটি BCI ব্যবহারের অনেক দরজা খুলে দেয়। সর্বশেষে ২০০০ সালের পর থেকে BCI আরও প্রাকটিক্যাল এবং বাস্তবমুখী হতে শুরু করে। ২০০৪ সালে, BrainGate নামে একটি বিখ্যাত BCI ডিভাইস তৈরি করা হয়। এটি তৈরি করেছিল Cyberkinetics নামের একটি কোম্পানি। BrainGate ছিল ইনভেসিভ (Invasive) BCI, যার মাধ্যমে প্যারালাইজড মানুষরা রোবোটিক হাত বা কম্পিউটার কার্সার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। BrainGate-এর মাধ্যমে BCI প্রযুক্তির চিকিৎসা ক্ষেত্রে সম্ভাবনা প্রদর্শিত হয়। এখানে আমরা দুই টা অপরিচিত শব্দ দেখতে পেলাম একটা ইনভেসিভ (Invasive) BCI অপরটা আনইনভেসিভ (Non-invasive) যা BCI প্রযুক্তিগত বিবর্তন এবং আরও একটা আছে সেটা হচ্ছে সেমি-ইনভেসিভ (Semi-invasive) BCI । প্রথমে আমরা যদি ইনভেসিভ (Invasive) BCI সম্পর্কে বলি এটি এমন একটা পদ্ধতি যেখানে মস্তিষ্কে সরাসরি ইলেকট্রোড স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে সর্বাধিক সঠিক এবং পরিষ্কার সংকেত পাওয়া যায়। সাধারণত পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী বা গুরুতর শারীরিক অক্ষমতা থাকা ব্যক্তিদের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। এর পর ননইনভেসিভ (Non-invasive) এই পদ্ধতিতে, ইলেকট্রোড মাথার খুলির বাইরের দিকে স্থাপন করা হয়। এটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, তবে সংকেত কম স্পষ্ট হয়। এই পদ্ধতি সাধারণত EEG ভিত্তিক হয়। সবশেষে সেমি-ইনভেসিভ (Semi-invasive) এতে ইলেকট্রোডগুলো মস্তিষ্কের বাইরে কিন্তু মাথার খুলির ভেতরের দিকে স্থাপন করা হয়, যা সিগন্যালের যথার্থতা বাড়ায় কিন্তু ঝুঁকিও থাকে। এই ভাবে দিনের পর দিন এই প্রযুক্তির গবেষণা এবং অগ্রগতি বেড়েই চলছে সাম্প্রতিক সময়ে, প্রযুক্তির মিরাকেল মান খ্যাত এলন মাস্কের কোম্পানি Neuralink মস্তিষ্কে সরাসরি চিপ স্থাপনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এই চিপগুলির সাহায্যে মানুষ শুধু চিন্তা করে বিভিন্ন ডিভাইস বা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো BCI ব্যবহার করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করা এবং মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোগ স্থাপন করা। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংস্থা DARPA (Defense Advanced Research Projects Agency) দীর্ঘদিন ধরেই BCI-এর উপর গবেষণা করছে। তাদের গবেষণার লক্ষ্য হলো মস্তিষ্ক এবং মেশিনের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করা এবং এর মাধ্যমে সেনাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এই ভাবে আধুনিক বিশ্বে BCI প্রযুক্তি এর মাধ্যমে অনেক জটিল ও কঠিন কাজ গুলা করে থাকবে বলে মনে করেন গবেষকরা এবং তারা এটাও মনে করেন যে অদুর ভবিষ্যতে এটি শুধু পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের সাহায্য করবে না, বরং সুস্থ মানুষদের জন্যও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন মেমোরি বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের দক্ষতা বাড়ানো, এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবস্থায় আরও ভালো অভিজ্ঞতা প্রদান করা এবং অতি তাড়াতাড়ি BCI প্রযুক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশে পরিণত হবে । এর ফলে আধুনিক বিশ্ব প্রযুক্তির দিকে আরেক একধাপ অগ্রসর হবে । সবশেষে একটা কথা থেকেই যায় আজ পর্যন্ত যত কিছু আবিষ্কার এবং প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে তার ফলে বিশ্ব যে আধুনিকায়ন হয়েছে অপর দিকে অনেক সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখিও হয়েছে তেমনি ভাবে BCI প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ আছে যেমন মস্তিষ্কের সংকেতগুলো অত্যন্ত জটিল এবং বিভিন্ন শব্দ বা নয়েজ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। সঠিক সংকেত শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা চ্যালেঞ্জিং। এছাড়াও যেহেতু BCI মস্তিষ্কের ভেতরের চিন্তা এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানতে পারে, তাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং তথ্যের নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয় এবং ইনভেসিভ পদ্ধতিগুলি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, বিশেষত যদি সেগুলি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহৃত হয়।
সবকিছু বিবেচনা করে আমরা অবশেষে বলতে পারি যে BCI প্রযুক্তি মানব ইতিহাসে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে। মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতা ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত, চিকিৎসা এবং মানবিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। BCI এখনো গবেষণার একটি ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্র হলেও, এর অসাধারণ সম্ভাবনা এবং সম্ভাব্য ব্যবহার আমাদের ভবিষ্যত জীবনকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।

আব্দুল ওয়াদুদ ইসলাম রতন
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

শেয়ার করুন

ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেইসের আদ্যোপান্ত

প্রকাশিত: ০২:১৪:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

প্রযুক্তির বিবর্তন কে আমরা সাধারণত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি । প্রথম পর্যায়টি হলো প্রুফ-অব-কনসেপ্ট (Proof-of-Concept), যেখানে একটি প্রযুক্তির মৌলিক কার্যকারিতা প্রদর্শন হয়। এই পর্যায়ে, কার্যক্ষমতাসম্পন্ন সিস্টেমগুলোও অত্যন্ত প্রভাবশালী এমন কি সামান্য কল্পনাকে তাড়িত করে । আর এই কারনেই প্রাথমিক ভাবে এগুলাকে ভুল বুঝে । উদাহরণস্বরূপ, যখন প্রথমবারের মতো মুভিং পিকচার বা চলমান ছবি তৈরি করা হয়েছিল, তখন মানুষ ফুলের দুলুনি বা সমুদ্রতীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার মতো সহজ ভিডিও ফুটেজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তেমনি, যখন কম্পিউটার মাউস প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল, মানুষ ছোট্ট একটি যন্ত্রকে টেবিলের উপর অল্প দূরত্বে সরিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে একটি পয়েন্টারকে দুই মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করার ধারণা নিয়ে বিস্মিত হয়েছিল। মস্তিষ্কের সংকেত ব্যবহার করে যেকোনো তথ্য সরাসরি মস্তিষ্ক থেকে আহরণ করতে পারার ক্ষমতা এই পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে সাধারণ পেশী সঞ্চালন প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো ইমুলেশন (Emulation), যেখানে প্রযুক্তিটি মূলত বিদ্যমান প্রযুক্তিগুলোর কার্যকারিতা নকল করার জন্য ব্যবহৃত হয় যেমন আমরা যদি দেখি যে প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলো ছিলো সাধারণত মঞ্চনাটকের রেকর্ড করা সংস্করণ । আর কম্পিউটার মাউস ব্যবহার করা হতো তালিকা থেকে আইটেম নির্বাচন করতে, ঠিক যেমনটা কিবোর্ডের নিউমেরিক প্যাড দিয়ে করা যেত। সবশেষে, প্রযুক্তিটি যখন তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন এটি নিজস্ব পরিপক্কতা লাভ করে। এই পর্যায়ে, ডিজাইনাররা নতুন প্রযুক্তির সূক্ষ্মতা বুঝতে ও কাজে লাগাতে শুরু করেন এবং এমন অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করেন, যা আগে কখনোই সম্ভব ছিল না।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ কল্পনা করে আসছিলো যে এমন একটা যন্ত্র তৈরি করার যা মানুষ চিন্তা করে যন্ত্রের সাথে যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া করতে পারে । এবং যা মানুষের মনের ভেতর উঁকি দিতে পারে এবং চিন্তাধারার অন্তর্নিহিত ভাবনা জানতে পারে। এই ধারণাগুলো প্রাচীন মিথ এবং আধুনিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মাধ্যমে মানবজাতির কল্পনাকে আকৃষ্ট করেছে। তবে, এটি কেবল সাম্প্রতিক সময়েই সম্ভব হয়েছে, যখন কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স এবং ব্রেইন ইমেজিং প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে আমরা সরাসরি মানব মস্তিষ্কের সাথে ইন্টারফেস করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। এই সক্ষমতা সম্ভব হয়েছে সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে, যা মস্তিষ্কের ভেতরে ঘটে যাওয়া কিছু শারীরিক প্রক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে, যেগুলো নির্দিষ্ট ধরণের চিন্তার সাথে সম্পর্কিত। আর এই প্রযুক্তি কে বলা হয় ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস যাকে সংক্ষেপে (BCI ) বলে । BCI এমন এক ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা যা মস্তিষ্কের সাধারণ আউটপুট পথ, যেমন পেরিফেরাল নার্ভ এবং পেশির ওপর নির্ভর করে না। এই ব্যবস্থায়, ব্যবহারকারীরা কম্পিউটার বা কমিউনিকেশন ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে হাত এবং যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপের মাধ্যমে সংকেত তৈরি করে।
প্রথমে আমরা BCI প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু আলোচনা করি , Brain-Computer Interface (BCI)-এর ইতিহাস অনেকটাই বিজ্ঞানের ফ্রন্টিয়ারে অবস্থান করে। যদিও এটি আধুনিক যুগের একটি প্রযুক্তি, এর পিছনে গবেষণা ও উন্নয়নের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । ১৯২৪ সালের দিকে জার্মান বিজ্ঞানী হ্যান্স বার্গার (Hans Berger) প্রথমবারের মতো মানুষের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ রেকর্ড করতে সক্ষম হন। তিনি এটির নাম দেন Electroencephalography (EEG)।যা কোনো প্রাণীর মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগন্যাল রেকর্ড করার প্রক্রিয়া। আর এর মাধ্যমেই তিনি ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস এর মূল ভিত্তি স্থাপন করেন । আর কিছুদিন পরে ১৯৬০ এর দশকে একজন বিখ্যাত নিউরোসায়েন্টিস্ট জোসে ডেলগাডো (José Delgado) প্রথম মস্তিষ্কে সরাসরি বৈদ্যুতিক উদ্দীপনার মাধ্যমে আচরণ পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। ডেলগাডোর গবেষণা দেখায় যে মস্তিষ্কের সংকেতগুলি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণীদের আচরণ পরিবর্তন করা সম্ভব। যদিও এই গবেষণা অনেক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, তারপরেও এটি BCI-এর বিকাশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসাবে কাজ করে ছিল। এর পর ১৯৭০ এর দশকে Jacques J. Vidal নামের এক গবেষক প্রথমবারের মতো “Brain-Computer Interface” শব্দটি ব্যবহার করেন শুধু তাই নয় ১৯৭৩ সালের দিকে তিনি এক গবেষণায় দেখান যে কিভাবে EEG ব্যবহার করে সরাসরি মস্তিষ্কের সংকেত থেকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর মাধ্যমে Brain-Computer Interface প্রাথমিক পথ উন্মুক্ত হয় । এর ১৯৯০ এর দশকে BCI গবেষণা মূলত ফোকাস করে ননইনভেসিভ (Non-invasive) পদ্ধতির উপর, যেখানে মস্তিষ্কের সংকেতগুলি স্ক্যাল্পের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়। মস্তিষ্ক থেকে সংগ্রহকৃত EEG সংকেতগুলিকে আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ এবং প্রসেস করার জন্য উন্নত অ্যালগরিদম এবং কম্পিউটার প্রসেসিং শক্তির উন্নতি ঘটে। এটি BCI ব্যবহারের অনেক দরজা খুলে দেয়। সর্বশেষে ২০০০ সালের পর থেকে BCI আরও প্রাকটিক্যাল এবং বাস্তবমুখী হতে শুরু করে। ২০০৪ সালে, BrainGate নামে একটি বিখ্যাত BCI ডিভাইস তৈরি করা হয়। এটি তৈরি করেছিল Cyberkinetics নামের একটি কোম্পানি। BrainGate ছিল ইনভেসিভ (Invasive) BCI, যার মাধ্যমে প্যারালাইজড মানুষরা রোবোটিক হাত বা কম্পিউটার কার্সার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। BrainGate-এর মাধ্যমে BCI প্রযুক্তির চিকিৎসা ক্ষেত্রে সম্ভাবনা প্রদর্শিত হয়। এখানে আমরা দুই টা অপরিচিত শব্দ দেখতে পেলাম একটা ইনভেসিভ (Invasive) BCI অপরটা আনইনভেসিভ (Non-invasive) যা BCI প্রযুক্তিগত বিবর্তন এবং আরও একটা আছে সেটা হচ্ছে সেমি-ইনভেসিভ (Semi-invasive) BCI । প্রথমে আমরা যদি ইনভেসিভ (Invasive) BCI সম্পর্কে বলি এটি এমন একটা পদ্ধতি যেখানে মস্তিষ্কে সরাসরি ইলেকট্রোড স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে সর্বাধিক সঠিক এবং পরিষ্কার সংকেত পাওয়া যায়। সাধারণত পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী বা গুরুতর শারীরিক অক্ষমতা থাকা ব্যক্তিদের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। এর পর ননইনভেসিভ (Non-invasive) এই পদ্ধতিতে, ইলেকট্রোড মাথার খুলির বাইরের দিকে স্থাপন করা হয়। এটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, তবে সংকেত কম স্পষ্ট হয়। এই পদ্ধতি সাধারণত EEG ভিত্তিক হয়। সবশেষে সেমি-ইনভেসিভ (Semi-invasive) এতে ইলেকট্রোডগুলো মস্তিষ্কের বাইরে কিন্তু মাথার খুলির ভেতরের দিকে স্থাপন করা হয়, যা সিগন্যালের যথার্থতা বাড়ায় কিন্তু ঝুঁকিও থাকে। এই ভাবে দিনের পর দিন এই প্রযুক্তির গবেষণা এবং অগ্রগতি বেড়েই চলছে সাম্প্রতিক সময়ে, প্রযুক্তির মিরাকেল মান খ্যাত এলন মাস্কের কোম্পানি Neuralink মস্তিষ্কে সরাসরি চিপ স্থাপনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এই চিপগুলির সাহায্যে মানুষ শুধু চিন্তা করে বিভিন্ন ডিভাইস বা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো BCI ব্যবহার করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করা এবং মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোগ স্থাপন করা। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংস্থা DARPA (Defense Advanced Research Projects Agency) দীর্ঘদিন ধরেই BCI-এর উপর গবেষণা করছে। তাদের গবেষণার লক্ষ্য হলো মস্তিষ্ক এবং মেশিনের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করা এবং এর মাধ্যমে সেনাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এই ভাবে আধুনিক বিশ্বে BCI প্রযুক্তি এর মাধ্যমে অনেক জটিল ও কঠিন কাজ গুলা করে থাকবে বলে মনে করেন গবেষকরা এবং তারা এটাও মনে করেন যে অদুর ভবিষ্যতে এটি শুধু পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের সাহায্য করবে না, বরং সুস্থ মানুষদের জন্যও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন মেমোরি বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের দক্ষতা বাড়ানো, এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবস্থায় আরও ভালো অভিজ্ঞতা প্রদান করা এবং অতি তাড়াতাড়ি BCI প্রযুক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশে পরিণত হবে । এর ফলে আধুনিক বিশ্ব প্রযুক্তির দিকে আরেক একধাপ অগ্রসর হবে । সবশেষে একটা কথা থেকেই যায় আজ পর্যন্ত যত কিছু আবিষ্কার এবং প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে তার ফলে বিশ্ব যে আধুনিকায়ন হয়েছে অপর দিকে অনেক সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখিও হয়েছে তেমনি ভাবে BCI প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ আছে যেমন মস্তিষ্কের সংকেতগুলো অত্যন্ত জটিল এবং বিভিন্ন শব্দ বা নয়েজ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। সঠিক সংকেত শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা চ্যালেঞ্জিং। এছাড়াও যেহেতু BCI মস্তিষ্কের ভেতরের চিন্তা এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানতে পারে, তাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং তথ্যের নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয় এবং ইনভেসিভ পদ্ধতিগুলি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, বিশেষত যদি সেগুলি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহৃত হয়।
সবকিছু বিবেচনা করে আমরা অবশেষে বলতে পারি যে BCI প্রযুক্তি মানব ইতিহাসে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে। মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতা ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত, চিকিৎসা এবং মানবিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। BCI এখনো গবেষণার একটি ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্র হলেও, এর অসাধারণ সম্ভাবনা এবং সম্ভাব্য ব্যবহার আমাদের ভবিষ্যত জীবনকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।

আব্দুল ওয়াদুদ ইসলাম রতন
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর