রাজনীতিমুক্ত শিক্ষার্থী বান্ধব উপাচার্য চান যবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা
- প্রকাশিত: ০২:৫৭:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / 43
যবিপ্রবি প্রতিনিধি:
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে শুরু করেন। তবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের(যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: আনোয়ার হোসেন পদত্যাগ না করায় ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নানা অনিয়ম-দূর্নীতি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় থাকা শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ দিয়ে মেরে হল ছাড়া করা, ঐসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে না দেওয়া সহ নানান অভিযোগে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তোপের মুখে ২১ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন অধ্যাপক ড. মো: আনোয়ার হোসেন। এরপর থেকে নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় সময় অতিবাহিত করছে শিক্ষার্থীরা, চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
অভিভাবক শূণ্য ৩৫ একরে কে হবেন উপাচার্য? কেমন হবে উপাচার্যের গুণাবলি, তিনি কতটুকু শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষক হবেন ইত্যাদি সব প্রশ্ন উঠছে শিক্ষার্থী মহলে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যবিপ্রবির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছেন আমাদের এ প্রতিবেদক। শিক্ষার্থীদের মতামতে উঠে এসেছে নানা সমস্যা, সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা।
গণিত বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ নাঈম হোসেন জানান, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর তাদের নির্বাচিত উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। অভিভাবকহীন যবিপ্রবির ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ, গবেষণামুখী, শিক্ষানুরাগী একজন উপাচার্য চাই। যিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করবেন, একইসাথে ক্যাম্পাসে সকল প্রকার দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করবেন, ছাত্র সংসদের মাধ্যমে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। শিক্ষকদের গবেষণা ও যোগ্যতার বিচারে প্রশাসক হিসাবে পদায়ন করবেন। ভিসি হবেন সবার জন্য, কোন নির্দিষ্ট ফ্যাকাল্টি বা নিদিষ্ট এলাকার লোকজনের জন্য নয়। ইটের বিল্ডিংয়ের উন্নতির পাশাপাশি আধুনিক ও বাস্তব সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু, গবেষণামুখী, স্বজনপ্রীতি মুক্ত, সেশনজট মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দিতে পারবেন এমন একজন ভিসি চাই।
বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং (বিএমই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন তিনি অবশ্যই অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হবেন। একসময় শিক্ষাগত যোগ্যতা, নৈতিকতা এবং প্রশাসনিক যোগ্যতাই ছিল উপাচার্য নিয়োগের মাপকাঠি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দলের প্রতি আনুগত্যটাই যেন বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হোক সে নৈতিকতা বর্জিত, হোক সে অযোগ্য। ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পেয়েছি উপাচার্যের যে অবস্থান,মর্যাদা বা আত্মসম্মান বোধ ছিল তা হ্রাস পেয়েছে। ২৪ এর বিপ্লবের পর শুধুমাত্র এই কারণে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন বা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত মান বৃদ্ধি করতে, বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা নির্ভর করতে একজন স্বশিক্ষিত এবং নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এই ব্যাপারে একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমার বা আমাদের চাওয়া হলো তিনি অবশ্যই নিরপেক্ষ হবেন, সব সময় শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করবেন কোনভাবেই স্বৈরাচারী মনোভাবের হবেন না।
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুরাইয়া পারভীন জানান, যবিপ্রবির একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমি একজন শিক্ষার্থীবান্ধব ভিসি চাই। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবেন। যেমন- গবেষণা, পর্যাপ্ত ডিজিটাল সুবিধা, সঠিক ভাবে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের বহির্বিশ্বের সাথে যুগোপযোগী করে নিজেদের তৈরি করতে পারে। এছাড়া ভিসির নিজের স্বকীয়তা থাকবে, কারণ এমন বড় একটি স্থানে বসে যদি তিনি অন্যের কথায় চলেন তাহলে তিনি ঐ স্থানকে বিকিয়ে দিবেন। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনের বিষয়ে কখনো উদাসীন হবেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিরসনে কাজ করবেন। উপাচার্য হবেন সবার জন্য, কোন ব্যক্তি বিশেষ বা ফ্যাকাল্টি বিশেষ কিংবা এলাকা বিশেষের জন্য নয়। সকলকে সমান পাল্লায় বিচার করবেন, কাছে টেনে নেবেন।
কেমিকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছাব্বির খন্দকার বলেন, আমরা নৈতিক এবং শিক্ষার্থীবান্ধব ভিসি চাই যিনি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রোল মডেল হতে পারেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে কোনো আপোস করবেন না। আমি গত আড়াই বছর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি, এখানে শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রাহ্য করা হয় না। শিক্ষার্থীদের থেকে শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরই সুযোগ সুবিধাকে প্রধান্য দেওয়া হয়। আকস্মিক ফি নামের অদ্ভুত শিরোনামে শিক্ষার্থীদের পকেট কাটা হয়। দিন দুপুরে লিফটের টাকা গায়েব হয়ে যায়। ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ, আর যখন নামমাত্রে চালু ছিলো তখনও চড়া মূল্যে কিনতে হতো, হলের খাবারের মান নিম্ন। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফ সায়েন্সের বা এপ্লাইড সায়েন্সের পুরাতন বিভাগ গুলোর পর্যাপ্ত সু্যোগ সুবিধা নিশ্চিত না করেই যত্রতত্র নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। যেইটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা। যিনি আমাদের নতুন উপাচার্য হবেন তাকে অবশ্যই এসকল বিষয়ে দূরদর্শী মনোভাবাপন্ন হতে হবে। আমরা যেনো তার কাছে বিনা দ্বিধায় যেকোনো সমস্যা নিয়ে যেতে পারি। তাকে হতে হবে অরাজনৈতিক, দূর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ এবং স্বজনপ্রীতীর উর্ধের ব্যক্তিত্ব।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামিউল আজিম বলেন, স্বৈরাচারি খুনি সরকারের পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তার দোসর হিসেবে থাকা ভিসিরা শিক্ষার্থীদের চাপে পদত্যাগ করেন। যবিপ্রবিও এ ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। ভিসি হিসেবে সর্বপ্রথম যে চাওয়া একজন রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ এবং শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। যাতে রাজনৈতিকভাবে কোন শিক্ষার্থী হেনস্থার শিকার না হয়। তাঁর শিক্ষাজীবন হতে হবে বর্ণাঢ্য যাতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ে সঠিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করে কাজ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় হলো চর্চার স্থান। বিভিন্ন গবেষণা,আচার ,চিন্তার স্থান থেকে আমাদের হতে হবে বিশ্বমানের। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই চর্চার শুরু করতে পারেনি। ভিসি হিসেবে তাঁর মধ্যে এটা নিয়ে চিন্তা থাকতে হবে এবং কাজ করার মনোবল থাকতে হবে। শুধু শিক্ষার্থী বান্ধবই না একজন ভিসি হিসেবে চাইব সৎ এবং সাহসী চরিত্রের ব্যক্তিত্বকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিষয়ে কঠোর হতে হয় যার কারণে এই দুই গুণাগুণ থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি। ভিসির স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে, যার মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন দিকে নিয়ে যেতে চান তা স্পষ্ট করে তুলতে পারবেন।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো: মাহফুজুর রহমান জানান, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা আর “দলান্ধ” বা পক্ষপাতমূলক ভিসির পুনরাবৃত্তি দেখতে চাইনা। আমরা চায় এমন একজন আসুক যিনি সমস্ত পক্ষের প্রতি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ থাকবেন এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করবেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সবার মতামত ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করবেন। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকে মুক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদী উন্নতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবেন। সর্বোপরি আমরা চাই এমন একজন ভিসি আসুক যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত উন্নতি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন।