জাবিতে মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা, বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকি: কী ভাবছে প্রশাসন?
- প্রকাশিত: ০৪:০১:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫
- / 54
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই জাবিতে মশাদের রাজত্ব কায়েম হয়। সন্ধ্যার পর আবাসিক হলগুলোতে চরম মাত্রায় বেড়েছে মশার উৎপাত। দরজা জানালা বন্ধ করলেও কোথা থেকে যেন ধেয়ে আসে রক্তখেকো মশাদের দল। মশার কয়েল বা এরোসল যেন কোন কাজেই আসছে না। দিনের বেলাতেও মশারি টাঙাতে হয়। তবুও যেন নিস্তার পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। এর ফলে ব্যাঘাত ঘটছে চিরশান্তির ঘুমে, বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় সম্ভাবনা। অন্যদিকে ক্লাস, পরীক্ষায় অংশ নেওয়াও যেন দূঃষ্কর হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদান বিদ্যমান থাকলেও মশার আতংকে শিক্ষার্থীদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মশার উপদ্রবে জাবি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সার্বিক পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, দিনের বেলায় মশার উৎপাত না থাকলেও রাতের বেলা শুধু আবাসিক হলগুলোতেই নয় বরং পুরো ক্যাম্পাসেই মশারা ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তমঞ্চ, মুরাদ চত্তর, মুন্নী সারনী, সুইজারল্যান্ড, মনপুরা, পরিবহন চত্ত্বর, টিএসসি, সেন্ট্রাল ফিল্ড, সুন্দরবনসহ ক্যাম্পাসের লোক সমাগমের সকল স্থানেই মশাদের উপদ্রব বেড়ে গেছে। এতে করে মশার কামড়ে বেড়েছে মশাবাহিত রোগীদের সংখ্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাসিক হলগুলোর আশপাশের এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানের জলাশয়, ড্রেন ও ময়লা-আবর্জনা গুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় মশার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। মশা নিধনে বিভিন্ন আবাসিক হলে একাধিকবার স্প্রে করা হলেও মশা কমার পরিবর্তে মশার আক্রমণ বেড়ে গেছে। ফলে, মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ মশা নিধনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদক্ষেপ গুলো যথেষ্ট নয়। হলগুলোর আশেপাশের জলাশয়গুলো কচুরিপানা ও ময়লা আবর্জনা জমে মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। মশার এসব অভয়ারণ্য গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সারাবছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনা।
সরেজমিন দেখা যায়, মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ নিয়ম মাফিক ছিটানো হয় না। ক্যাম্পাসের অধিকাংশ জায়গায় দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে জমে থাকে অপরিষ্কার পানি। লেকগুলোর আশপাশ ভরে আছে ঝোঁপঝাড়ে। এছাড়া যত্রতত্র জমে আছে ময়লা-আর্বজনার স্তূপ। ঝোঁপঝাড় পরিষ্কারের কোন বালাই নেই। ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্নতায় নেই কোন অভিযান। বাতাস উঠলে ধুলোবালিতে ছেয়ে যায় ক্যাম্পাস। নর্দমায় জমে থাকা অপরিষ্কার পানিতে মশা-মাছি ডিম পেড়ে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানে নেই কার্যকরী কোন পদক্ষেপ।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা কী বলছেন?
কামালউদ্দিন হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রেদোয়ান মিয়া বলেন, আগে এতো মশা ছিলো না। এখন মশার জ্বালায় রুমে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। রুমে কয়েল লাগালেও মশা কমছে না। পড়াশোনা তো হচ্ছেই না। কয়েকদিন পর পর জ্বরে ভুগতে হয়।
প্রীতিলতা হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাইমা রোজ বলেন, জাহাঙ্গীরনগরে সবকিছুই সুন্দর, শুধু মশারা অসুন্দর। দিনের বেলা কম থাকে কিন্তু সন্ধ্যা হলেই মশার উৎপাত শুরু হয়ে যায়। এখন আমার টিউটোরিয়াল পরীক্ষা চলছে। এতো মশা যে রুমে পড়াই যাচ্ছে না। মশারীর ভিতর থেকে পড়ছি। না জানি কবে অসুস্থ হয়ে যাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পড়তে আসা অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হিমেল হাসান বলেন, সামনে আমার পরীক্ষা। মশার উপদ্রবে হলে পড়া হয়না। তাই লাইব্রেরিতে আসছি এখানেও মশা। তাই কয়েল নিয়ে আসছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল কতৃপক্ষের পদক্ষেপ কী?
শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, আমরা হলে সপ্তাহে দুইবার করে স্প্রে করতেছি। তবুও মশা কমছে না। এছাড়াও হলের দায়িত্বরত কিছু স্টাফদের নিয়ে আশেপাশের ঝোঁপঝাড় পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করেছি কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে মশা নিধনে এর থেকে উচ্চতর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না।
রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফারুক আহমেদ বলেন, মশা নিধনে প্রত্যেকটি হল এবং অফিস আলাদাভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমরাও আমাদের হলে নিয়মিত স্প্রে করতেছি। এছাড়া তো আপাতত কিছু করার নেই। হলের আশেপাশে ঝোঁপঝাড় আর নর্দমা থাকার কারণে মশার উপদ্রব টা একটু বেড়ে গেছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলের সদ্য সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি বলেন, আমি এখন আর হল প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে নাই তবে আমি মনে করি মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে তারা যেমন অসুস্থ হবে তেমনি পড়াশোনারও ব্যাঘাত ঘটবে। সেজন্য নিয়মিত মশা নিধনের জন্য স্প্রে করতে হবে। ঝোঁপঝাড়, নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবা নিতে আসা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন মিয়া বলেন, আমার ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা চলছে। হলে মশার উপদ্রবে থাকা যায়না। পড়াও হচ্ছে না। দুইদিন থেকে আমার জ্বর। তাই আজকে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসছি। আমার মতো আরও অনেকেই আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের কী অবস্থা?
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের উপ-প্রধান মেডিকেল অফিসার ডা. শ্যামল কুমার শীল বলেন, আমার কাছে এমন অনেক রোগীই আসছে যারা জ্বরে আক্রান্ত। অনেককেই ডেঙ্গু টেস্ট দিয়েছি। তবে ডেঙ্গু রোগীর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। ক্যাম্পাসের ভিতরের ঝোঁপঝাড় আর নর্দমার পঁচা পানি পরিষ্কার না করলে এই মশার বংশবৃদ্ধি কমানো সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের প্যাথলজী বিভাগ থেকে জানা যায়, অনেকেই জ্বর নিয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করাচ্ছে। রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সন্ধ্যার পর মশার কামড়ের স্বীকার হচ্ছেন। এই সময় এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কী বলছে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এ বি এম আজিজুর রহমান বলেন, মশা নিধনের ব্যাপারে নিয়ম হলো কোথাও মশার উপদ্রব বেড়ে গেলে এস্টেট অফিসে জানাতে হয়, আবাসিক হলগুলো থেকে লোকবল দিলে আমরা হলগুলোতে স্প্রে চিটানোর ব্যবস্থা করে দিব। প্রয়োজনীয় উপকরণও দেবো। কিন্তু এখনো সে রকম সহযোগিতা আমাদের কাছে চাওয়া হয়নি। যদি এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য আমাদের কাছে আবেদন জানানো হয় তাহলে আমরা সহযোগিতা করবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ডেপুটি রেজিস্ট্রার) মোঃ আবুল কাশেম বলেন, এ বিষয়ে আবাসিক হলগুলোর কতৃপক্ষ স্ব স্ব হলে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এখানে আমাদের কোন কাজ নাই। আমরা শুধু ডোপ বিতরণ করি, মেশিন বা সংশ্লিষ্ট কোন উপকরণ চাইলে আমরা সেগুলো সরবারাহ করি। হল কতৃপক্ষ নিয়মিত স্প্রে করছে। কোন সহযোগিতা চাইলে আমরা করবো।
এ বিষয়ে মশা গবেষকরা কী জানাচ্ছে?
মশা গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, জাবিতে আগে এত মশা ছিলো না। এটা ইদানীং বেড়েছে। মশা বৃদ্ধির মূলত কিছু বিষয় থাকে। জাবিতে নতুন নতুন বিল্ডিং নির্মাণ হচ্ছে। যার ফলে নগরায়নের সাথে সাথে এডিস মশাও বংশবৃদ্ধি করছে। এছাড়া ক্যাম্পাসে ঝোঁপঝাড় বেশি। নর্দমায় পানি জমে থাকে। এখানে কিউলেক্স মশা ডিম পাড়ে। অতিদ্রুত ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার, উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা করতে না পারলে মশার উপদ্রব কমানো সহজ হবে না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য কী?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাই উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, আমরা মিটিং এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। সকল হল কতৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছি তারা যেন নিয়মিত স্প্রে করে। সেক্ষেত্রে হল গুলোর নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যয় হবে। আমরা প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করবো।
ক্যাম্পাসে ঝোঁপঝাড় পরিষ্কারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আবাসিক হলগুলোর আশেপাশে যে ঝোঁপঝাড়, নর্দমা বা ডোবা আছে ওগুলো পরিষ্কার করার জন্য হলগুলোয় পর্যাপ্ত লোকবল আছে। তাদের ভালো পরিমানে বেতনও দেওয়া হয়। হল কতৃপক্ষের মাধ্যমে তারা কাজ করবে। এছাড়াও আমাদের কাছে যে কোন ধরনের সহযোগিতা চাইলে আমরা রেসপন্স করবো।