নতুন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি :
- প্রকাশিত: ০৭:১৫:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫
- / 23
বিগত সাড়ে পনেরো বছর দেশের কোন স্তরেই কোন রাজনীতি অবশিষ্ট ছিল না। যা ছিল দখলদারিত্ব ও লুটপাটের সংস্কৃতি। সেটাকে কোনভাবেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলার সুযোগ নেই। সেটাকে স্রেফ আওয়ামী দূঃশাসন বলা চলে। সে দুঃশাসন ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত করে। যার প্রভাব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক আকারে পড়েছে। বাংলাদেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল না।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও লুটপাট আর অবৈধ ক্ষমতা চর্চার কারখানায় রূপান্তরিত হয়।
বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই দুঃশাসনকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের হয়ে লড়াই জারি রেখেছিল একমাত্র রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। অবিরাম দুঃশাসনের ফলে অনেক ছাত্র সংগঠন সরকারি সংগঠনের ছায়াতলে থেকে স্বৈরাচারকে দীর্ঘায়িত করলেও ছাত্রদল রাষ্ট্রের প্রশ্নে কখনোই আপোষ করেনি।যার ফলশ্রুতিতে ছাত্রদলকে বরণ করে নিতে হয়েছে মানবেতর জীবনযাপনকে।যেখানে ন্যূনতম নিরাপত্তা ছিল না। গুম,খুন,কারাগার ও হাসপাতালই ছিল ছাত্রদলের নিত্য সঙ্গী। জীবনের সকল সম্ভাবনা কে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের তরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মানবেতর জীবন যাপনে অভ্যস্ত করেছে যে অনুভূতি, সেই অনুভূতির নামই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সব থেকে নিপীড়িত রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এভাবে টানা সাড়ে ১৫ বছরের দীর্ঘ লড়াই স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোন ছাত্র সংগঠনকে করতে হয়নি।
একটা দীর্ঘ লড়াইয়ের পর একটি গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপদানের সুযোগ আসে ২০২৪ সালের ৫ জুন থেকে। যার গোড়াপত্তন ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সংগঠনের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ থাকলেও ছাত্রদলকে বিভিন্ন অজুহাতে আন্দোলন থেকে দূরে রাখার অব্যাহত চেষ্টা চালানো হয়। যার ফলশ্রুতিতে ছাত্রদল নিজেরাই আলাদা “কোটা পর্যালোচনা গ্রুপ” নামক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে আন্দোলনকে এক দফায় প্রভাবিত করার কাজ চালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে সফলও হয়। এই গ্রুপ থেকেই ১৪ তারিখ রাতে হাসিনাকে গোটা দেশে স্বৈরাচার শব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ২৪ এর গণ আন্দোলন কে গণঅভ্যুত্থানে প্রভাবিত করতে ছাত্রদলের অবদান অস্বীকার্য। এই গণঅভ্যুত্থানে একক রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন হিসেবে গত পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪৩ জন শহীদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ আন্দোলন এক দফায় প্রভাবিত করতে বহু বাধা বিপত্তি ও হুমকির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। একটা সময় সকলকে প্রভাবিত করে মাঠে নামিয়ে ছাত্রদলকেই আবার “জিরো পার্সেন্ট কন্ট্রিবিউশন,হান্ড্রেড পার্সেন্ট সেলিব্রেশন” নামক মবের শিকার হতে হয়েছে। হাসিনার পতন পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে চরম পর্যায়ের বৈষম্যের শিকার হতে হয়।
একটা দীর্ঘ সময় যারা হাসিনার দুঃশাসনে বাক স্বাধীনতা হারিয়ে আই হেট পলিটিক্স বলা শুরু করেছিল, রাতারাতি প্রোফাইল লাল করার মাধ্যমে আন্দোলনের স্টেক নিয়ে তারাই একযোগে পাক্কা রাজনীতিবিদ বনে গেছেন এবং বিগত পনের বছরের দুঃশাসনকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের প্রশ্নে আপসহীন থাকা সংগঠনকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন। বিগত সাড়ে পনেরো বছরে বাংলাদেশের সকল ক্যাম্পাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।দীর্ঘ সময়ে আই হেট পলিটিক্সকে ধারণ করে হুট করে আই লাভ পলিটিক্সে রূপান্তরিত হয়ে বিগত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াইরত জাতীয়তাবাদী শক্তিকে হীন স্বার্থে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা কোনভাবেই একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সুখকর নয়।
নতুন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ভিত্তি হতে হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সমন্বয়ে। যারা রাজনীতিতে জড়াবেন তাদের বুঝতে হবে নেতৃত্ব কোন ক্ষমতাচর্চার ফ্যাশন নয়, নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব। সামনের দিনগুলোতে যারা সে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন তারাই নেতৃত্ব দেবেন। আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিগত দীর্ঘ দুঃশাসনের ভিকটিম হিসেবে ও পতিত স্বৈরাচারের কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর। আমরা স্বপ্ন দেখি কোন প্রকার দখলদারিত্ব, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি, চাঁদাবাজি, ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া প্রভৃতি জাতীয় সকল প্রকার আওয়ামী রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে ক্যাম্পাসগুলোকে পরিপূর্ণ মুক্ত করা। আমরা স্বপ্ন দেখি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, রেজাল্ট, গবেষণা, সহশিক্ষাসহ একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ও রাষ্ট্রের প্রশ্নে আপসহীন এবং দেশ প্রেমিক মনোভাব তৈরিতে ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের ছায়া হয়ে পাশে থাকবে। আমরা স্বপ্ন দেখি ক্যাম্পাস প্রশাসন শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেদের মেরুদন্ড বিকিয়ে দেবেন না। আর যেন কখনোই প্রশাসনের কাজে ছাত্র সংগঠনগুলো হস্তক্ষেপ করতে না পারে। আর সেই আপসহীনতা প্রশাসনকেই প্রদর্শন করতে হবে।কিন্তু গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের জায়গায় ছাত্র প্রতিনিধি নামে কমিটি তৈরি করে আবারো প্রশাসনে আধিপত্য তৈরি করার দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে, যা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো পতিত স্বৈরাচারের সহযোগীরা বিদ্যমান। যার ফলশ্রুতিতে আধিপত্য সৃষ্টির একটা সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। আমরা মনে করি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে স্বৈরাচারের সমর্থকদের অব্যাহতি দিয়ে দক্ষ,সৎ কর্মকর্তাদের নিয়োগ নিশ্চিত করে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের সুযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণভাবে পড়ার টেবিলে ফিরতে হবে। যার যেখানে দায়িত্ব আমাদের সেখানে অবস্থান করাটাই প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সকলের মাঝে একটি রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক সচেতনতা মানেই রাজনীতিবিদ নয়। রাজনীতি আলাদা জগত এবং একটি প্রসিদ্ধ শিল্প। যার কোন নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই। পরিস্থিতি মোকাবেলার মাধ্যমে যা অর্জন করে নিতে হয়। রাজনীতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই রাজনৈতিক সচেতন সকল শিক্ষার্থীর উচিত রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যারা রাজনৈতিক জীবনকে বেছে নিয়েছে তাদের সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করে তাদের সমর্থন জানিয়ে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করা। আর যেনো কোন ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের মতো দানব হয়ে উঠতে না পারে।
লেখক- মোঃ আবিদুল ইসলাম খান
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।