আমার বিছানা এখন মেঝে, আমার জানালা—পলিথিনের ছিদ্র
- প্রকাশিত: ১১:৪৩:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
- / 83
মুহতাসিম নোয়েল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাগোর্নো-কারাবাখের পাহাড়ি উপত্যকা আজ নিঃস্ব। গত সেপ্টেম্বরে আজারবাইজানের সামরিক অভিযানের পর প্রাণ বাঁচাতে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর লক্ষাধিক মানুষ ছুটেছেন সীমান্তের দিকে। পথে ফেলে এসেছেন বাড়ি, সমাধি, জন্মভূমির গন্ধ মাখা স্মৃতি। জাতিসংঘের হিসাবে, মাত্র এক সপ্তাহে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ পরিণত হয়েছেন শরণার্থীতে—এযুগের অন্যতম দ্রুততম বাস্তুচ্যুতি।
শরণার্থী শিবিরগুলোর অবস্থা ক্রমশ ভয়াবহ। আর্মেনিয়ার সিসিয়ান শহরের একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে ৫০০ পরিবার বাস করছেন টিনের চালায়। শীত আসতেই তীব্র হচ্ছে কম্বল ও জ্বালানির সংকট। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ “হিউম্যানিটি ফার্স্ট”-এর প্রতিবেদন বলছে, প্রতি ১০টি পরিবারের ৭টিই দিনে একবেলা গরম খাবার পায় না। শিশুদের ৬০% স্কুলে যেতে পারছে না—অনেকের হাতেই বইয়ের বদলে জুটেছে পানির বালতি।
এই সংকটের সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক—নিরাপত্তাহীন নারী ও শিশুরা। শরণার্থীদের ৮৫%ই নারী ও শিশু, যাদের অনেকেই যাত্রাপথে হারিয়েছেন পরিবারের পুরুষ সদস্যদের। কিশোরী একজনের ডায়েরিতে লেখা: “আমার বিছানা এখন মেঝে, আমার জানালা—পলিথিনের ছিদ্র।” আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সতর্ক করেছে, মানসিক আঘাত ও পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগছেন ৪০% বাস্তুচ্যুত।
অন্যদিকে, আজারবাইজানের দাবি, তারা “আইনানুগ ভূমি পুনরুদ্ধার” করছে। কিন্তু স্থানীয় আর্মেনীয় গ্রামগুলোতে আজারবাইজানি পতাকা উড়লেও জনবসতি প্রায় শূন্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিধাবিভক্তিও বাড়াচ্ছে সংকট। রাশিয়া ও তুরস্কের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোয় বাধা তৈরি হচ্ছে। ইউএন হিউম্যানিটেরিয়ান এজেন্সির তথ্য বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় সাহায্য পৌঁছেছে মাত্র ৩৫%।
তবুও স্থানীয় উদ্যোগে জ্বলে উঠছে আশার আলো। আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে স্থপতি ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ১২টি অস্থায়ী স্কুল। সেখানে শরণার্থী শিশুদের পড়ানো হয় ইতিহাস ও শিল্পের মাধ্যমে—”যুদ্ধ নয়, সৃজনশীলতাই আমাদের মুক্তি,” বলছে এক শিক্ষিকা। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
ভূ-রাজনীতির হিসাব-নিকাশে যখন মানুষ হারায় পরিচয়, তখনই ধ্বংস হয় সভ্যতার মাপকাঠি।