উদ্যোক্তা হতে হলে অনেক গুলো বিষয় সমানতালে থাকা দরকার: মাহবুব
- প্রকাশিত: ০৮:৫৯:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪
- / 33
তপ্ত রোদে লিখতে বসেছি। লিখতে বসেছি এক হার না মানা তরুণের জীবনের সংক্ষিপ্ত ঘটনার নিয়ে। পাশের বাসার টিনের তাপে যেভাবে আমার শরীরকে উত্তপ্ত করছে, যেন মনে হয় আমি কোনো এক বিগলিত লাভা। আর এই তপ্ত গরমেই লিখছি এক তরুণের জীবন কাহিনী। কথা বলছিলাম নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার পোরকরা গ্রামে জন্ম নেওয়া এক দুরন্ত বালকের। নাম তার মো. মাহবুবুর রহমান হাসিব। যার শৈশব কেটেছে দুরন্তপনায়। কেটেছে লাটিম ঘুরিয়ে কিংবা কানামাছি খেলে। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে পোরকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেটি নোয়াখালী সোনাইমুড়ীর পোরকরাতেই অবস্থিত। মাধ্যমিক দিয়েছে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের বিপুলাসার আহাম্মদ উল্ল্যাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। বিজ্ঞান বিভাগ হতে। হাইস্কুলের গন্ডি টপকিয়ে ভর্তি হয়েছে পলিটেকনিকে। তবে এই পথ এতো সহজ ছিল না। মাহবুব গতানুগতিক নিজের টার্মের বাহিরে যাওয়ার চেষ্টা করে। তার এই ব্যক্তিগত ধ্যান ধারণা থেকেই মাধ্যমিকে থাকতেই পলিটেকনিকে পড়ার ইচ্ছা লালন করতেন। তার সঙ্গে পাবলিকিয়ান টুডে’র প্রতিনিধি হাসিবুর রশীদ যোগাযোগ করেন। তিনি প্রতিনিধিকে বলেন, “এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির আবেদন করেছিলাম। যেহেতু পলিটেকনিকে আবেদন করার পর আমার ভর্তি নাও হতে পারে। এছাড়া পলিটেকনিক ভর্তির আবেদনের কিছুদিন আগে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তির আবেদন শুরু হতো।
একাদশ শ্রেনীতে আবেদন করলেও আমি ঔখানে ভর্তি হইনি। কিন্তু এদিকে পলিটেকনিক ভর্তিতে আমার নাম আসছিলো না। আবারও একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির আবেদন করি এবং পাশাপাশি পলিটেকনিক ভর্তি ফলাফলের অপেক্ষা করছিলাম। পলিটেকনিক ভর্তির প্রায় ৪টা ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরও আমার নাম না আসায় হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম। এমতাবস্থায় পরেরদিন একাদশ শ্রেনীতে ভর্তির শেষ তারিখ ছিল, ভর্তি না হলে আর ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই। আল্লাহর রহমতে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তির শেষ তারিখে পলিটেকনিক ভর্তির ৪র্থ ওয়েটিং লিস্ট ফলাফল চলে আসে এবং আমার নাম আসে। এরপর লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই।”
মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই মাহবুবুর জানে জীবন কী জিনিস? জানে কীভাবে নিজেকে প্রতিকূল ধ্বংসাত্মক পরিবেশেও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয়। তিনি পলিটেকনিক লাইফ সম্পর্কে বলেন, “পলিটেকনিকে আসা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে।পারিবারিক সংকটের কারণে আমাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বহুবার ভাবতে হয় এবং পা ফেলতে হয় গুনে গুনে। পলিটেকনিক লাইফ নিয়ে সংক্ষেপে বলা অনেক কঠিন। অল্প কথায় বলতে গেলে আমরা এখানে মুখস্থ বিদ্যায় যতটা ফোকাস করি তার ৫% ফোকাস করি না কোনো বিষয়ের উপর বাস্তবিক অভিজ্ঞতা নেওয়ার। এখানে আমাদের বিরাট গ্যাপ ছিলো স্কিল ডেভেলপমেন্টে। একেবারে সত্য কথা অকপটে বলতে হলে বলা যায় যে, কারিগরি শিক্ষা হাতে-কলমে হওয়ার পরিবর্তে এখন মুখস্থ বিদ্যায় রূপ নিয়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষায় গুরুত্ব দিলেও বাকিদের ক্ষেত্রে তা লক্ষ্য করা যায় না। এতে আমি কোনো শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানকে দোষ দিতে রাজি নয়। কারণ আমাদের গোটা সিস্টেমই ভঙ্গুর।
আবার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিজের মনগড়া নিয়মে চলে। কখনো কোনো স্কিল ডেভেলপমেন্টের প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে, আমিও এমনই একজন ছিলাম।”
লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ডিবেটিং সোসাইটি (এলপিডিএস) প্রাক্তন সদস্যও ছিলেন। তিনি ডিবেটিং সোসাইটিতে বেশ একটিভ ছিলেন। প্রতিনিধি মাহবুবুরকে এলপিডিএস সম্পর্কে বলতে বললে তিনি বলেন, “এটি এমন একটি প্লাটফর্ম, যেখান থেকে অনেক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস পেয়েছি। সবার সামনে নিজেকে মেলে ধরা, বহু মানুষের সামনে কথা বলার জড়তা দূর করা, নিজের প্রতিভা বিকশিত করার অনবদ্য সুযোগ সৃষ্টি করে এই প্লাটফর্ম। এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক, জেলা পর্যায় এবং বিভাগীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছে আমার।”
মাহবুব নিজের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট সম্পর্কে বলেন, “পলিটেকনিক জীবনের ৭টা সেমিস্টারে আমার মধ্যে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং ক্যারিয়ার ভিত্তিক কোনো চিন্তা ভাবনা আসেনি। একেবারে সহজ কথায় মনে হতো আমরা সিস্টেমের মধ্যে বন্দী এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখা অবান্তর।
কিন্তু ৭ম সেমিস্টারের পর যখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এ্যাটাচমেন্টে গেলাম সেখানে আমার চিন্তাজগত বিকশিত হয় বাস্তবতার নিরিখে। সেখানে একজন ইঞ্জিনিয়ারের কথায় আমি এতো বেশি পরিমাণ প্রভাবিত হই যে আমার জীবনের অনেক সিদ্ধান্ত ওই ইঞ্জিনিয়ারের কথার উপর ভিত্তি করে নিয়েছি।এছাড়া আমাদের পলিটেকনিকের একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বলেছিলেন, ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট কখনো বৃথা যায় না। তোমরা স্কিল ডেভেলপমেন্ট করলে সেটা তোমাদের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কাজে আসবেই।’
এরপর থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু এবং স্বপ্নের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা আরম্ভ করলাম।”
মাহবুব একজন উদ্যোক্তাও। তিনি ডিপ্লোমা শেষ করার পরে চাকরি করেন। এবং চাকরির পাশাপাশি নিজে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। মাহবুবকে উদ্যোক্ত হওয়ার গুণাবলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “উদ্যোক্তা হতে হলে অনেক গুলো বিষয় সমানতালে থাকা প্রয়োজন। যেমন – দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দৃঢ় মনোবল। এগুলোর কোনোটি ছাড়া উদ্যোক্তা হওয়া কঠিন এবং উদ্যোক্তা হলেও দীর্ঘস্থায়ী টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
চাকরি করে হোক বা যেভাবেই অভিজ্ঞতা নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। মাঠ পর্যায়ে টিকে থাকা কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়। দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করেই এপথে পা বাড়াতে হয়। সকল বিষয় বিবেচনা করে আমি ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করি বাড়ি নির্মাণ ভিত্তিক ডিজাইন এবং তত্বাবধানের প্রতিষ্ঠান ‘এইচবি ডিজাইন এন্ড কনসালটেন্সি’। এখন পর্যন্ত ৫৬টি বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করেছি।”
মাহবুব চাকরির পাশাপাশি ফেনী ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি করছেন। বিএসসি শেষে নিজের প্রতিষ্ঠানের পরিধি বৃদ্ধি করার স্বপ্ন দেখছেন। পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কার্যক্রম শুরু করার দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করেছেন।
পাবলিকিয়ান টুডে’র প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, “আমি প্রথমেই বর্তমান বাংলাদেশ এবং বাঙালিকে হিংসা মুক্ত জাতি হিসেবে দেখতে চাই। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ হিংসায় জর্জরিত এবং সুযোগের অভাবে সৎ। সুযোগ পেলেই বেশিরভাগ মানুষ নিজের জাত চেনাতে ভুলে যায় না। নিজের দোষটা কেউ দেখতে পায় না তাই সমালোচনার কেন্দ্রে থাকে অন্যের দোষত্রুটি। উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের নিজ দেশের মানুষই। স্বাধীনতার পর পৃথিবীর অনেক পিছিয়ে থাকা দেশ আজ উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে গেছে। কিন্তু আমরা আমাদের চিন্তা ভাবনায় কিংবা দেশপ্রেমে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে কয়েকশো বছর পিছিয়ে আছি। আমরা নিজেরা ঠিক না হলে দেশ কখনও ঠিক হবে না।”
অনুজদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলব যে, পড়াশোনার পাশাপাশি অবশ্যই স্কিল ডেভেলপমেন্টে ফোকাস করতে হবে। পরিবর্তিত আধুনিক বিশ্বে নিজেকে মানিয়ে নিতে হলে স্কিল ডেভেলপমেন্টের বিকল্প নেই।”
যারা বর্তমানে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “উদ্যোক্তা হওয়ার পূর্বে দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দৃঢ় মনোবল, দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। সকল বিষয় বিবেচনা না করে উদ্যোক্তা হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
মাহবুব বর্তমানে বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক। তার মতো বাংলাদেশ বেশ কয়েকজন কঠোর পরিশ্রমী ও দৃঢ় মনোবলের নাগরিক চায়। বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে চাকরির ক্ষেত্র বাড়াতে এবং বেকার সমস্যা দূরীকরণে উদ্যোক্তা হতে হবে। এটি একটি উপায় বা পথ মাত্র। এছাড়াও আরো নানান পথ খোলা রয়েছে।
হাসিবুর রশীদ
ক্যাম্পাস প্রতিনিধি, এলপিআই