০৭:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশে গুড়িয়ে দেয়া হলো লাখ টাকার ভাস্কর্য

অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:
  • প্রকাশিত: ১১:২৫:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
  • / 447

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত ‘অঞ্জলি লহ মোর’ শিরোনামের ভাস্কর্যটি ছুটির দিনে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিতে ভেঙে ফেলা হয়েছে। নতুন প্রশাসনের নির্দেশেই ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।

ভাস্কর্যটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ এবং পুরাতন কলা অনুষদের মাঝখানের পুকুরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থাপন করা হয়। পুকুর সংস্কারের প্রায় ৪ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার চুক্তিতে এটি নির্মিত হয়েছিল।

তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের সময়ে ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশেই এটি ভাঙার কাজ শুরু হয়।

রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, “বিষয়টি আমি জানি না। প্রকল্প বা পরিকল্পনা দপ্তর ভালো বলতে পারবে।”

প্রকৌশল দপ্তরের উপ-প্রধান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুল ইসলামও বলেন, “আমি কিছু জানি না। পরিকল্পনা দপ্তর ও প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলুন।”

পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, “বর্তমান প্রশাসন ভাস্কর্যটি গ্রহণ করছে না। তাই এটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। উপাচার্য স্যারের পক্ষ থেকেই সিদ্ধান্ত এসেছে। প্রথমে ছাত্ররাই আপত্তি জানিয়েছিল, ৫ আগস্টের পর তারা ভাঙার চেষ্টা করেছিল।”

তবে এমন আপত্তির কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা জানিয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো দাবি করা হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক ড. জয়নুল আবেদীন সিদ্দিকী বলেন, “আগে ডিনদের নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে এটি ছিল। কেউ কেউ ভাস্কর্যটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হয়তো ভাঙা হচ্ছে।”

ভাস্কর্যটি গোপনে ভাঙা এবং এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন শিক্ষকরা। অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তানজিল হোসেন বলেন, “ভাস্কর্য ভাঙার পেছনে যদি প্রশাসনিক বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে থাকে, তবে এটি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ধ্বংসের একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত। পূর্ববর্তী প্রশাসনের সবকিছু মুছে ফেলার চেষ্টাকে প্রগতিশীলতা বলা যায় না, বরং তা ইতিহাস মুছে ফেলার প্রচেষ্টা।”

চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল মনজুর এলাহী বলেন, “ছুটির সময়, স্টুডেন্টদের অনুপস্থিতিতে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমার মতে, ভাস্কর্যটি ভাঙার বদলে সংশোধন করা যেত।”

ভাস্কর্যটির অনুপ্রেরণা ছিলেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ। তিনি বলেন, “কেউ বলতে পারেনি কেন এটি ভাঙা হলো। ‘অঞ্জলি লহ মোর’ আমার হাতের ছবি থেকে তৈরি করা হয়েছিল। এটি ভাস্কর্যশিল্পী মনিন্দ্র পাল করেছিলেন। খুবই দুঃখজনক ঘটনা এটি।”

ভাস্কর্যশিল্পী মনিন্দ্র পাল বলেন, “ভাস্কর্যটি ভাঙা হচ্ছে শুনে আমি থানার ওসি, চারুকলা অনুষদের ডিন ও প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ভ্যাট ছাড়া ১৫ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু এখনো ৭ লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের জানালেও গড়িমসি করছে।”

শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ আপত্তি জানালেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী মনে করছেন, এটি একটি অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, যা একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য নষ্ট করছে, অন্যদিকে জনসাধারণের অর্থের অপচয় ঘটছে।

শেয়ার করুন

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশে গুড়িয়ে দেয়া হলো লাখ টাকার ভাস্কর্য

প্রকাশিত: ১১:২৫:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত ‘অঞ্জলি লহ মোর’ শিরোনামের ভাস্কর্যটি ছুটির দিনে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিতে ভেঙে ফেলা হয়েছে। নতুন প্রশাসনের নির্দেশেই ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।

ভাস্কর্যটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ এবং পুরাতন কলা অনুষদের মাঝখানের পুকুরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থাপন করা হয়। পুকুর সংস্কারের প্রায় ৪ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার চুক্তিতে এটি নির্মিত হয়েছিল।

তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের সময়ে ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশেই এটি ভাঙার কাজ শুরু হয়।

রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, “বিষয়টি আমি জানি না। প্রকল্প বা পরিকল্পনা দপ্তর ভালো বলতে পারবে।”

প্রকৌশল দপ্তরের উপ-প্রধান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুল ইসলামও বলেন, “আমি কিছু জানি না। পরিকল্পনা দপ্তর ও প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলুন।”

পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, “বর্তমান প্রশাসন ভাস্কর্যটি গ্রহণ করছে না। তাই এটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। উপাচার্য স্যারের পক্ষ থেকেই সিদ্ধান্ত এসেছে। প্রথমে ছাত্ররাই আপত্তি জানিয়েছিল, ৫ আগস্টের পর তারা ভাঙার চেষ্টা করেছিল।”

তবে এমন আপত্তির কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা জানিয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো দাবি করা হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক ড. জয়নুল আবেদীন সিদ্দিকী বলেন, “আগে ডিনদের নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে এটি ছিল। কেউ কেউ ভাস্কর্যটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হয়তো ভাঙা হচ্ছে।”

ভাস্কর্যটি গোপনে ভাঙা এবং এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন শিক্ষকরা। অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তানজিল হোসেন বলেন, “ভাস্কর্য ভাঙার পেছনে যদি প্রশাসনিক বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে থাকে, তবে এটি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ধ্বংসের একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত। পূর্ববর্তী প্রশাসনের সবকিছু মুছে ফেলার চেষ্টাকে প্রগতিশীলতা বলা যায় না, বরং তা ইতিহাস মুছে ফেলার প্রচেষ্টা।”

চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল মনজুর এলাহী বলেন, “ছুটির সময়, স্টুডেন্টদের অনুপস্থিতিতে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমার মতে, ভাস্কর্যটি ভাঙার বদলে সংশোধন করা যেত।”

ভাস্কর্যটির অনুপ্রেরণা ছিলেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ। তিনি বলেন, “কেউ বলতে পারেনি কেন এটি ভাঙা হলো। ‘অঞ্জলি লহ মোর’ আমার হাতের ছবি থেকে তৈরি করা হয়েছিল। এটি ভাস্কর্যশিল্পী মনিন্দ্র পাল করেছিলেন। খুবই দুঃখজনক ঘটনা এটি।”

ভাস্কর্যশিল্পী মনিন্দ্র পাল বলেন, “ভাস্কর্যটি ভাঙা হচ্ছে শুনে আমি থানার ওসি, চারুকলা অনুষদের ডিন ও প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ভ্যাট ছাড়া ১৫ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু এখনো ৭ লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের জানালেও গড়িমসি করছে।”

শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ আপত্তি জানালেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী মনে করছেন, এটি একটি অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, যা একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য নষ্ট করছে, অন্যদিকে জনসাধারণের অর্থের অপচয় ঘটছে।