০১:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নোবিপ্রবিতে ছাত্ররাজনীতি: ভিন্ন বাস্তবতা ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্ভাবনা

মিরাজ মাহমুদ, নোবিপ্রবি প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত: ১১:১০:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫
  • / 44

জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পরিবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা – সমালোচনা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের(নোবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের মাঝেও এই বিষয়ে আলোচনা – সমালোচনা চলছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও
রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির সহ অন্যান্য সংগঠনগুলো যা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া।

এমন পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতিতে ভিন্ন বাস্তবতা ও ছাত্রসংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এর নেতৃবৃন্দের মতামত তুলে ধরেছেন ❝পাবলিকিয়ান টুডে❞ প্রতিনিধি মিরাজ মাহমুদ।

এম আই এস ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জায়েদুল ইসলাম বলেন:লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসের জন্য অভিশাপ।ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু রাজনীতি বিদ্যমান থাকা উচিত। কিন্তু লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মধ্যে বিবাদ ছাড়া কখনো সুফল বয়ে আনে না। ছাত্ররাজনীতির অতীত ইতিহাস আমলে রেখে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া সময়ের দাবি।
প্রশাসনের কাছে আহ্বান থাকবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে একটা ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি না করে অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে স্বচ্ছ একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে ক্যাম্পাসে গনতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার সুযোগ দিবেন।

ফলিত গণিত বিভাগ ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবেদিন মিনহাজ বলেন:মানুষ মূলত রাজনৈতিক প্রাণী, জীবন ও জীবিকার সব সিদ্ধান্তেই রাজনীতির প্রভাব বিদ্যমান, তাই জনতার উচিত রাজনৈতিক বিষয়ে ন্যূনতম হলেও সচেতন হওয়া। আবার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রেও ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর সুস্থ পরিবেশ নষ্টের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায় লেজুড়ভিত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতির, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও এভাবে নেই। এই উভয় সংকট নিরসনে ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি হওয়া উচিত সুস্থ, গঠনমূলক ও নিরপেক্ষ। যদি দলীয় সংগঠনগুলো এমন সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ক্যাম্পাসে দলীয় ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। এর ভালো বিকল্প হতে পারে ছাত্র সংসদভিত্তিক সুস্থ ছাত্ররাজনীতি, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবে। ক্যাম্পাসের হলগুলোর নিয়ন্ত্রণও থাকতে হবে প্রশাসনের হাতে, কোন দলীয় সংগঠনের হাতে না। তবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত হবে। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে একটাই চাওয়া, জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের রক্ত যেন কোনোভাবেই বৃথা না যায়। দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় আমাদের সবার।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোয়াখালী জেলার সদস্যসচিব নোবিপ্রবি এমআইএস বিভাগের শিক্ষার্থী বনি ইয়ামিন বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীসহ আমরা সকলেই চাচ্ছি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক, যেটা নিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রস্তুতি চলছে। তবে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল সেটি চাচ্ছে না তারা বিষয়টিকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে। ছাত্র সংসদ হলেও সাধারণত বিভিন্ন প্যানেল তৈরি হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো থেকে যেমন: ছাত্রদল, ছাত্রশিবির। তখনও সাধারণত ছাত্ররাজনীতি ওপেন থাকে। আমাদের ক্যাম্পাসের চিত্র ভিন্ন, এখানে ছাত্র রাজনীতি আগে থেকেই নিষিদ্ধ। ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না সেটি সম্পূর্ণ শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের উপর। ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংসদের ব্যাপারে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সাথে ডায়ালগ করুক, শিক্ষাঙ্গনে কতটুকু রাজনৈতিক চর্চা করা যাবে বা তার পরিসীমা কতটুকু হবে তা নির্ধারিত হোক। আর যদি শিক্ষার্থীরা রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস চায় তাহলে তাই থাকুক।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোবিপ্রবির সমন্বয়ক ও ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম হাসান বলেন, নোবিপ্রবিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। তা সত্বেও নামে বেনামে বিভিন্ন সংগঠন ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে প্রশাসনের অবস্থান পরিষ্কার না আমাদের কাছে। প্রশাসনের উচিত ওপেন ডিবেটের আয়োজন করা এবং ছাত্রদের ম্যান্ডেট নেওয়া। যদি ক্যাম্পাসের মেজরিটিরা দলীয় ছাত্ররাজনীতি চায় এবং কেমন রাজনীতি চায়; সেসকল সব বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এসব বিষয়ে প্রশাসনকে বারবার অবগত করার পরেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশাসননের স্বচ্ছতা নিয়ে আমাদের মধ্যে নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমরা রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ না। ক্যাম্পাসে যারা রাজনীতি করতে চায়, তাদের সাথে আমরা একসাথে জুলাই আন্দোলন করেছি। বারবার রাজনীতি বিরোধী কর্মসূচি করে আমরা তাদের মুখোমুখি হতে চাই না। দ্রুত এসবকিছুর সমাধানে আসা হউক। প্রশাসন যদি অতিদ্রুত যৌক্তিক কোনো সমাধানে না আসে, তাহলে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা অস্থিতিশীলবিহীন ক্যাম্পাস চাই। এর সমাধান প্রশাসন দিবে এবং প্রশাসনকেই দিতে হবে।

বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির, নোবিপ্রবি শাখার সভাপতি আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে ছাত্র রাজনীতির মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তবে স্বৈরাচারী শাসনের সময় ছাত্র রাজনীতিতে দমন-পীড়ন বৃদ্ধি পায়, এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র ঐক্য আন্দোলন সামরিক শাসকের পতন নিশ্চিত করে। কিন্তু ২০০০-এর দশকে এসে ছাত্র রাজনীতি ক্রমেই দলীয়করণ, সহিংসতা ও ক্ষমতাদখলের প্রতিযোগিতায় রূপ নিতে শুরু করে, যা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরিয়ে আনা হয়, তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন পুনরায় চালু করতে হবে এবং ছাত্র রাজনীতিকে সহিংসতা ও লেজুড়বৃত্তির বাইরে আনতে হবে। তা না হলে একসময়ের গৌরবময় ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতি এক নতুন গতিপথে প্রবাহিত হয়েছে। আগামী প্রজন্মের দায়িত্ব হবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে পুনরায় ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা। আমি চাই আমাদের নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসেও এমনটি বাস্তবায়ন হোক।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, নোবিপ্রবি শাখার আহ্বায়ক, নূর হোসেন বাবু বলেন: আমরা মনে করি আগে ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে  হবে।
যার যার অবস্থান থেকে রাজনীতি চর্চার পথ উন্মুক্ত হলে পরেই ছাত্র সংসদের দিকে চিন্তা কিরা যায়। কেননা দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফলে ছাত্রদলের সাংগঠনিক কাঠামো কিছুটা অগোছালো যা গোছানোর কাজ চলমান। নোবিপ্রবিতে সেটা প্রক্রিয়াধীন। বিপরীতে অন্যান্য সংগঠন প্রকাশ্য রাজনীতি না করা কিংবা কোনো কোনো সংগঠন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে মুখোমুখি না হওয়ার কারণে নিজেরা সাংগঠনিকভাবে অক্ষত থেকেছে নয়তো ছাত্রলীগের মধ্যে আত্মগোপনের মাধ্যমে নিজেদের সুসংগঠিত রেখেছে। এমতাবস্থায়  ছাত্রসংসদ নির্বাচন কখনোই প্রতিযোগিতা মূলক হবে না বরং একটা গোষ্ঠীকে একচ্ছত্র সুবিধা দেওয়ার ক্ষেতে তৈরী হবে।

তাই এখন থেকে একটা যৌক্তিক সময় পর্যন্ত (সেটা হতে পারে ১-১.৫ বছর) ছাত্ররাজনীতি উন্মুক্ত থাকা উচিত। সবাই সবার মতো সাংগঠনিক কার্যক্রম করার মাধ্যমে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হওয়ার পরেই সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করছি। নাহয় এটা অনেকটা ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো হবে।

ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, নোবিপ্রবি শাখার সভাপতি মো: খলিল উল্লাহ বলেন, প্রথমত, রাজনীতি বলেন আর ছাত্র রাজনীতি বলেন এটা দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। রাজনীতিতে সবাইকে একই চক্ষুতে কল্পনা করা উচিত না। ক্যাম্পাসে বিগত স্বৈরাচার সরকারের ছাত্র সংগঠন যে অপকর্ম করেছে তার দ্বায় অন্য সংগঠন গুলোর উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার হরণ যেমন কাম্য নই, ঠিক তদ্রূপ ভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতের গুরুত্বও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সে হিসেবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস প্রশাসন যদি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি না চায়, তাহলে আমরাও তাদের মতামতের সাথে শ্রদ্ধাশীল থাকবো। তবে, একটি ক্যাম্পাসে অভ্যন্তরিন নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা, শিক্ষার্থীদের যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকা, ক্যাম্পাসের সুশৃঙ্খল সৌন্দর্য ফেরাতে অবশ্যই আমরা ছাত্র সংসদের পক্ষে। আমরা আশা রাখি, যে বা যারাই ছাত্র সংসদে দায়িত্বে আসবে তারা হবে শিক্ষার্থী বান্ধব, যাদের মধ্যে কোনো স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্ম নিবেনা।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন:
বিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির যে ভয়াবহতা তা ছাত্ররা দেখেছে, এক্ষেত্রে ছাত্ররা লেজুর ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি চায় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডিতে থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। আমরা চাই মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বে ও আমাদের ফেকাল্টি ভিত্তিক যেসব ক্লাস প্রতিনিধিরা আছে তাদেরকেই প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্বে নিয়ে আসা যাবে বলে আমরা মনে করি। আমরা সুস্থ ধারার রাজনীতি চাই, শুধু শিক্ষার্থীদের চাহিদার আলোকেই সুস্থ ধারার রাজনীতি হবে, কোন প্রকার লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নয়, যা শিক্ষার্থীদের আবেদন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। সেটা হলেই সব ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।

শেয়ার করুন

নোবিপ্রবিতে ছাত্ররাজনীতি: ভিন্ন বাস্তবতা ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ১১:১০:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫

জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পরিবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা – সমালোচনা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের(নোবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের মাঝেও এই বিষয়ে আলোচনা – সমালোচনা চলছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও
রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির সহ অন্যান্য সংগঠনগুলো যা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া।

এমন পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতিতে ভিন্ন বাস্তবতা ও ছাত্রসংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এর নেতৃবৃন্দের মতামত তুলে ধরেছেন ❝পাবলিকিয়ান টুডে❞ প্রতিনিধি মিরাজ মাহমুদ।

এম আই এস ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জায়েদুল ইসলাম বলেন:লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসের জন্য অভিশাপ।ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু রাজনীতি বিদ্যমান থাকা উচিত। কিন্তু লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মধ্যে বিবাদ ছাড়া কখনো সুফল বয়ে আনে না। ছাত্ররাজনীতির অতীত ইতিহাস আমলে রেখে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া সময়ের দাবি।
প্রশাসনের কাছে আহ্বান থাকবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে একটা ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি না করে অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে স্বচ্ছ একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে ক্যাম্পাসে গনতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার সুযোগ দিবেন।

ফলিত গণিত বিভাগ ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবেদিন মিনহাজ বলেন:মানুষ মূলত রাজনৈতিক প্রাণী, জীবন ও জীবিকার সব সিদ্ধান্তেই রাজনীতির প্রভাব বিদ্যমান, তাই জনতার উচিত রাজনৈতিক বিষয়ে ন্যূনতম হলেও সচেতন হওয়া। আবার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রেও ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর সুস্থ পরিবেশ নষ্টের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায় লেজুড়ভিত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতির, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও এভাবে নেই। এই উভয় সংকট নিরসনে ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি হওয়া উচিত সুস্থ, গঠনমূলক ও নিরপেক্ষ। যদি দলীয় সংগঠনগুলো এমন সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ক্যাম্পাসে দলীয় ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। এর ভালো বিকল্প হতে পারে ছাত্র সংসদভিত্তিক সুস্থ ছাত্ররাজনীতি, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবে। ক্যাম্পাসের হলগুলোর নিয়ন্ত্রণও থাকতে হবে প্রশাসনের হাতে, কোন দলীয় সংগঠনের হাতে না। তবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত হবে। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে একটাই চাওয়া, জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের রক্ত যেন কোনোভাবেই বৃথা না যায়। দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় আমাদের সবার।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোয়াখালী জেলার সদস্যসচিব নোবিপ্রবি এমআইএস বিভাগের শিক্ষার্থী বনি ইয়ামিন বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীসহ আমরা সকলেই চাচ্ছি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক, যেটা নিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রস্তুতি চলছে। তবে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল সেটি চাচ্ছে না তারা বিষয়টিকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে। ছাত্র সংসদ হলেও সাধারণত বিভিন্ন প্যানেল তৈরি হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো থেকে যেমন: ছাত্রদল, ছাত্রশিবির। তখনও সাধারণত ছাত্ররাজনীতি ওপেন থাকে। আমাদের ক্যাম্পাসের চিত্র ভিন্ন, এখানে ছাত্র রাজনীতি আগে থেকেই নিষিদ্ধ। ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না সেটি সম্পূর্ণ শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের উপর। ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংসদের ব্যাপারে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সাথে ডায়ালগ করুক, শিক্ষাঙ্গনে কতটুকু রাজনৈতিক চর্চা করা যাবে বা তার পরিসীমা কতটুকু হবে তা নির্ধারিত হোক। আর যদি শিক্ষার্থীরা রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস চায় তাহলে তাই থাকুক।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোবিপ্রবির সমন্বয়ক ও ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম হাসান বলেন, নোবিপ্রবিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। তা সত্বেও নামে বেনামে বিভিন্ন সংগঠন ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে প্রশাসনের অবস্থান পরিষ্কার না আমাদের কাছে। প্রশাসনের উচিত ওপেন ডিবেটের আয়োজন করা এবং ছাত্রদের ম্যান্ডেট নেওয়া। যদি ক্যাম্পাসের মেজরিটিরা দলীয় ছাত্ররাজনীতি চায় এবং কেমন রাজনীতি চায়; সেসকল সব বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এসব বিষয়ে প্রশাসনকে বারবার অবগত করার পরেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশাসননের স্বচ্ছতা নিয়ে আমাদের মধ্যে নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমরা রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ না। ক্যাম্পাসে যারা রাজনীতি করতে চায়, তাদের সাথে আমরা একসাথে জুলাই আন্দোলন করেছি। বারবার রাজনীতি বিরোধী কর্মসূচি করে আমরা তাদের মুখোমুখি হতে চাই না। দ্রুত এসবকিছুর সমাধানে আসা হউক। প্রশাসন যদি অতিদ্রুত যৌক্তিক কোনো সমাধানে না আসে, তাহলে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা অস্থিতিশীলবিহীন ক্যাম্পাস চাই। এর সমাধান প্রশাসন দিবে এবং প্রশাসনকেই দিতে হবে।

বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির, নোবিপ্রবি শাখার সভাপতি আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে ছাত্র রাজনীতির মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তবে স্বৈরাচারী শাসনের সময় ছাত্র রাজনীতিতে দমন-পীড়ন বৃদ্ধি পায়, এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র ঐক্য আন্দোলন সামরিক শাসকের পতন নিশ্চিত করে। কিন্তু ২০০০-এর দশকে এসে ছাত্র রাজনীতি ক্রমেই দলীয়করণ, সহিংসতা ও ক্ষমতাদখলের প্রতিযোগিতায় রূপ নিতে শুরু করে, যা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরিয়ে আনা হয়, তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন পুনরায় চালু করতে হবে এবং ছাত্র রাজনীতিকে সহিংসতা ও লেজুড়বৃত্তির বাইরে আনতে হবে। তা না হলে একসময়ের গৌরবময় ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতি এক নতুন গতিপথে প্রবাহিত হয়েছে। আগামী প্রজন্মের দায়িত্ব হবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে পুনরায় ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা। আমি চাই আমাদের নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসেও এমনটি বাস্তবায়ন হোক।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, নোবিপ্রবি শাখার আহ্বায়ক, নূর হোসেন বাবু বলেন: আমরা মনে করি আগে ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে  হবে।
যার যার অবস্থান থেকে রাজনীতি চর্চার পথ উন্মুক্ত হলে পরেই ছাত্র সংসদের দিকে চিন্তা কিরা যায়। কেননা দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফলে ছাত্রদলের সাংগঠনিক কাঠামো কিছুটা অগোছালো যা গোছানোর কাজ চলমান। নোবিপ্রবিতে সেটা প্রক্রিয়াধীন। বিপরীতে অন্যান্য সংগঠন প্রকাশ্য রাজনীতি না করা কিংবা কোনো কোনো সংগঠন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে মুখোমুখি না হওয়ার কারণে নিজেরা সাংগঠনিকভাবে অক্ষত থেকেছে নয়তো ছাত্রলীগের মধ্যে আত্মগোপনের মাধ্যমে নিজেদের সুসংগঠিত রেখেছে। এমতাবস্থায়  ছাত্রসংসদ নির্বাচন কখনোই প্রতিযোগিতা মূলক হবে না বরং একটা গোষ্ঠীকে একচ্ছত্র সুবিধা দেওয়ার ক্ষেতে তৈরী হবে।

তাই এখন থেকে একটা যৌক্তিক সময় পর্যন্ত (সেটা হতে পারে ১-১.৫ বছর) ছাত্ররাজনীতি উন্মুক্ত থাকা উচিত। সবাই সবার মতো সাংগঠনিক কার্যক্রম করার মাধ্যমে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হওয়ার পরেই সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করছি। নাহয় এটা অনেকটা ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো হবে।

ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, নোবিপ্রবি শাখার সভাপতি মো: খলিল উল্লাহ বলেন, প্রথমত, রাজনীতি বলেন আর ছাত্র রাজনীতি বলেন এটা দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। রাজনীতিতে সবাইকে একই চক্ষুতে কল্পনা করা উচিত না। ক্যাম্পাসে বিগত স্বৈরাচার সরকারের ছাত্র সংগঠন যে অপকর্ম করেছে তার দ্বায় অন্য সংগঠন গুলোর উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার হরণ যেমন কাম্য নই, ঠিক তদ্রূপ ভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতের গুরুত্বও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সে হিসেবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস প্রশাসন যদি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি না চায়, তাহলে আমরাও তাদের মতামতের সাথে শ্রদ্ধাশীল থাকবো। তবে, একটি ক্যাম্পাসে অভ্যন্তরিন নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা, শিক্ষার্থীদের যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকা, ক্যাম্পাসের সুশৃঙ্খল সৌন্দর্য ফেরাতে অবশ্যই আমরা ছাত্র সংসদের পক্ষে। আমরা আশা রাখি, যে বা যারাই ছাত্র সংসদে দায়িত্বে আসবে তারা হবে শিক্ষার্থী বান্ধব, যাদের মধ্যে কোনো স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্ম নিবেনা।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন:
বিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির যে ভয়াবহতা তা ছাত্ররা দেখেছে, এক্ষেত্রে ছাত্ররা লেজুর ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি চায় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডিতে থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। আমরা চাই মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বে ও আমাদের ফেকাল্টি ভিত্তিক যেসব ক্লাস প্রতিনিধিরা আছে তাদেরকেই প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্বে নিয়ে আসা যাবে বলে আমরা মনে করি। আমরা সুস্থ ধারার রাজনীতি চাই, শুধু শিক্ষার্থীদের চাহিদার আলোকেই সুস্থ ধারার রাজনীতি হবে, কোন প্রকার লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নয়, যা শিক্ষার্থীদের আবেদন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। সেটা হলেই সব ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।